চলতি অর্থবছর ঊর্ধ্বমুখীই থাকবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি আরো কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে, যা গত অক্টোবরের ৮ দশমিক ২ শতাংশের চেয়েও বেশি। তবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা ধীরে ধীরে কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকায় সফর শেষে গতকাল এক বিবৃতিতে আইএমএফ মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও এ তথ্য জানান।
এর আগে গত ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত আইএমএফ মিশন দল বাংলাদেশে অবস্থান করে। ১৩ দিনব্যাপী পর্যালোচনা মিশন শেষে বিদায়ের আগে পাপাজর্জিও বলেন, ‘মিশনের সময় আমরা বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের সংস্কার এজেন্ডা, দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। দলগুলো আইএমএফ ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয়ে খুবই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।’
বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে দুর্বল কর রাজস্ব, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরেও ৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, কঠোর নীতিমালা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির কারণেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ ধীরগতি। চলতি বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি দুই অংকে পৌঁছলেও এখন কিছুটা কমে এসেছে। এর পরও তা উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে।’
আইএমএফের মতে, মূল্যস্ফীতি কার্যকরভাবে কমাতে মুদ্রানীতি আরো কিছু সময় কঠোর রাখা প্রয়োজন। বিবৃতিতে বলা হয়, মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখতে হবে। এছাড়া নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থার পূর্ণ বাস্তবায়ন ও বাড়তি শিথিলতা নিশ্চিত করতে হবে। কর প্রশাসন জোরদার, ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ ও সামাজিক সুরক্ষা জালের পরিধি বাড়ানোর কথাও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের সুশাসন উন্নত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে বলেও মন্তব্য করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানে সরকারের একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় কৌশল প্রয়োজন। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক মূলধন ঘাটতি নিরূপণ, সরকারি সহায়তার পরিধি নির্ধারণ ও আইনগতভাবে শক্তিশালী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্তসহ সব বড় ব্যাংকের সম্পদের মান যাচাই (একিউআর) সম্প্রসারণের ওপরও জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
জলবায়ু ঘাটতি পূরণে আরো দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা ও সবুজ বিনিয়োগ বাড়াতে স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই সুযোগ-সুবিধা (আরএসএফ) কর্মসূচির অধীনে এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে জলবায়ু অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে আরো দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
সামগ্রিকভাবে আইএমএফ বলেছে, কর ও ব্যাংক খাতে সংস্কার এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তবে সংস্কার বিলম্বিত হলে প্রবৃদ্ধি আরো মন্থর হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিবৃতিতে পাপাজর্জিও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে। তবে দুর্বল কর ব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের ঝুঁকি সমাধানে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’
আইএমএফ জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আগামী বছরের মে মাসের শেষ নাগাদ ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের পরবর্তী কিস্তি অনুমোদনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। এর আগে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে নতুন সরকারের সংস্কার এজেন্ডা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের শাসন ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, তবে দুর্নীতি দমন ও অর্থ পাচার প্রতিরোধ কাঠামো আরো শক্তিশালী করা দরকার। বিশেষ করে যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বলেও উল্লেখ করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ মিশন দলের সদস্যরা ঢাকায় অবস্থানকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীসহ বেসরকারি খাত, বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক করেন।


