অভ্যুত্থানের পরেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি বিমা খাতে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিমা খাতে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেনি আইডিআরএ। লাইফ বিমা খাতে যেসব কোম্পানির তহবিল তছরুপ হয়েছে তা উদ্ধার, গ্রাহকদের বকেয়া দাবি পরিশোধ, তহবিল তছরুপে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ—কোনো ক্ষেত্রেই তারা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। নন-লাইফ বিমা খাতেও অবৈধ কমিশন বন্ধ করা ও দক্ষ জনবল তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন খাত–সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত বিমা আইন–২০১০ সংশোধনী শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, বিমা আইন ২০১০ সালে প্রণীত হয়। এর মধ্যেই কেন সংশোধনীর প্রয়োজন হলো, সেটিও স্পষ্ট নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠিত হয় ২০১০ সালে, অথচ এখনো প্রেষণে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে, যাদের অধিকাংশেরই বিমা বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই। ফলে আইনটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়েছে কি না, আইন সংশোধনের আগে সেই বিষয়টি ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বিমা সংশ্লিষ্টদের মতে, বিমা কোম্পানি তদন্তে বিমা আইন ২০১০–এর ৪৮ ধারা, বিশেষ নিরীক্ষায় ২৯ ধারা, প্রশাসক নিয়োগে ৯৫ ধারা, চেয়ারম্যান–পরিচালক–মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার অপরাধে অপসারণে ৫০ ধারা, এবং আত্মসাৎ হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে ১৩৫ ও ১৩৬ ধারায় স্পষ্ট বিধান আছে। এসব বিধানের সঠিক প্রয়োগ হলে বিমা খাতের সংকট অনেকটাই নিরসন করা সম্ভব। তাই সংশোধনী প্রস্তাব আরও বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার আহ্বান জানান তারা।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সাবেক সদস্য সুলতান–উল–আবেদীন মোল্লা। তিনি বলেন, বিমা আইন–২০১০–এ ১৬০টি ধারা আছে এবং প্রতিটি ধারায় একাধিক উপধারা রয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবে মূল ১৬০ ধারার মধ্যে ৯৯টি ধারা অপরিবর্তিত রাখা হলেও সংশ্লিষ্ট উপধারাগুলো পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাকি ৬১টি ধারার উপধারাসহ পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত বা বাতিলের প্রস্তাবও করা হয়েছে। অধিকন্তু ৬৪টি নতুন ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আইডিআরএ শুধু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়; যেহেতু বিমা খাত অনুন্নত ও অবহেলিত, জনগণ বিমা সম্পর্কে সচেতন নয়, তাই উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্ব। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে উন্নয়নমুখী কোনো প্রস্তাব রাখা হয়নি।
সুলতান–উল–আবেদীন উল্লেখ বলেন, যে দেশের বিমা শিল্প যত উন্নত, তার অর্থনীতিও তত সমৃদ্ধ। বিমার সুফল সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে এটিকে সর্বজনীন করতে হবে এবং রিটেইল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজে বিমাকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা উভয়ের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আইন হতে হবে জনবান্ধব, কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থের কথা বলা হলেও বাস্তবে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার হলে বিমা শিল্প আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অসাধু ব্যক্তিরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে জনগণের অর্থ লুট করবে, ফলে মানুষ বীমার প্রতি আরও অনীহ হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের (বিআইপিডি) মহাসচিব কাজী মো. মোরতুজা আলী বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু অনেক সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়। সংশোধনী প্রস্তাব উন্নয়ন বান্ধব নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ–বান্ধব।
তিনি বলেন, আইডিআরএ প্রতিষ্ঠার আগে কোম্পানির সংখ্যা কম হলেও ব্যবসা বেশি ছিল। এখন কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু ব্যবসা কমেছে। যেখানে লাইফ বীমা খাতে এক কোটি পলিসিহোল্ডার ছিল, তা এখন ৫০ লাখে নেমে এসেছে।
মোরতুজা আলী আরও বলেন, সংশোধনী আইনে ‘অনুসন্ধানকারী’ একটি নতুন শব্দ যুক্ত হলেও ঝুঁকি বিজ্ঞান বা রিস্ক ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আইডিআরএ নিজ থেকেই পরিচালক বা নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।
বিমা আইন–২০১০ সংশোধনীর উল্লেখযোগ্য বিষয়—
সংশোধনী প্রস্তাবে মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিমা ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা বিমা খাতের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ইন্স্যুরটেক কোম্পানির সংজ্ঞা দেওয়া হলেও তাদের গঠন ও পরিচালনা পদ্ধতি উল্লেখ নেই।
করপোরেট এজেন্টের সংজ্ঞা দেওয়া হলেও নিয়োগ পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হয়নি। ব্যাংকাস্যুরেন্সে ব্যাংক করপোরেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
টপ ম্যানেজমেন্ট নিয়োগে আইডিআরএ অনুমোদন বাধ্যতামূলক বলা হলেও তাদের যোগ্যতা স্পষ্ট করা হয়নি।
শেয়ারহোল্ডার ফান্ড ও পলিসিহোল্ডার ফান্ড ২০১০ সালের আইনেই ছিল, এখন নতুন করে কেন উল্লেখ করা হলো সেটিও পরিষ্কার নয়।
ধারা ৩৯(গ)-তে ‘চেয়ারম্যান যদি যৌক্তিক মনে করেন’—এমন অস্পষ্ট ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যা ব্যক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তকে উৎসাহিত করতে পারে।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থকাগজ পত্রিকার সম্পাদক প্রণব মজুমদার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি গাজী আনোয়ারসহ অন্যান্যরা।


