সাবান ব্যবহারের প্রবণতা
আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে এই দেশের মানুষ বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষের সাবান ব্যবহারের প্রবণতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ফেসবুকে। সত্তর ও আশির দশক থেকে এটা শুরু হয়েছে। কারণ আমার স্মৃতির উপর নির্ভর করেই এটা রচিত হয়েছে। এই কারণে কিছু বিষয় বাদ পড়ে যেতে পারে। এক ফেসবুক বন্ধুর মন্তব্য তা প্রমাণ করলো। আমার সাবান বিষয়ক লেখায় তার মন্তব্যে গ্যাকোটাচ সাবানের কথা জানিয়েছেন। আসলেই আশির দশকে সৌন্দর্য্য সাবান হিসেবে কসকো ছিলো। সুস্বাস্থ্যের কথা বলতো লাইফবয়। আর গ্যাকোটাচ ভিন্নভাবে ব্র্যান্ডিংয়ে এলো। তারা বলেছিলো, শরীরে চুলকানি কমার কথা। আশির দশকে তারাও বিজ্ঞাপন দিতো। এ ধরনের সাবান আর সেভাবে তখন বাজারে আসেনি। ত্বক সুরক্ষার জন্য নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে এসে ডেটল ও স্যাভলন সাবান হিসেবে বাজারে এলো। শরীর জীবাণুমুক্ত রাখবে, এই স্লোগান নিয়ে তারা ভালোভাবেই বাজারে আছে। তবে গ্যাকোটাচ আমাদের দেশের নতুন প্রজন্ম চিনবেই না।
আশির দশকে ঢাকা শহরে বাথরুম ধোয়ার জন্য সবাই ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতো। ডিটারজেন্ট পাউডার আসার পর তা-ও ব্যবহার করা হতো। বাথরুম ধোয়ামোছার কাজে এখন হারপিক বাজার দখল করে আছে। তার আগে কিন্তু এগিয়ে ছিলো ভিনাইল। এখন তো বাথরুমের বেসিন, কমোড, ফ্লোর ধোয়ার জন্য আলাদা আলাদা ক্লিনিং উপকরণ বাজারে আছে। যেটা সত্তর-আশির দশকে আমরা ভাবতেও পারতাম না। অন্যদিকে ঘরের ভেতর ফ্লোর মোছার ক্ষেত্রে পানিই ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক কাল ধরে। তবে গত দুই-তিন দশকে একটু অবস্থাসম্পন্ন মানুষ কিংবা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে এ ধরনের লোকজন লাইজল ব্যবহার করে থাকে। এ ধরনের উপকরণে এটার বাজার অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
কিশোর বয়সে আজিমপুরে দেখতাম ফেরি করে কালা সাবান বিক্রি করতে আসতো লোকজন। এর ক্রেতা ছিলো মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার। তারা বিভিন্ন কাজে এটা ব্যবহার করতো। নব্বইয়ের শুরু থেকে কালা সাবান বিক্রেতারা হারিয়ে যেতে থাকে। আমাদের মহল্লায় মহিলারা আসতো ছাই বিক্রি করতে। বাসাবাড়িতে ছাই তখন ছিলো অপরিহার্য উপকরণ। ঢাকা শহরে তখন গ্যাসের কিংবা কেরোসিনের তেলের চুলা ব্যবহৃত হতো। চুলা থেকে ছাই উৎপাদনের সুযোগ ছিলো না। তাই থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল ধোয়ার জন্য ছাই দরকার পড়তো। আবার মাছ কাটতে, মাছ ধৌত করতে ছাইয়ের প্রয়োজন পড়তো।
নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এসে প্লেট, হাড়ি ধোয়ার কাজে ছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হতো সাবান কিংবা ডিটারজেন্ট পাউডার। নতুন শতক আসার পর থেকে ভিম বার জনপ্রিয়তা পায়। এখন তো লিকুইড আকারেও রয়েছে। এগুলো ঘরগৃহস্থালি কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে ছাই একেবারে হারিয়ে যায়নি। অভ্যাসের কারণে এখনো ধোয়ার কাজে ছাইয়ের ব্যবহার কিছুটা রয়ে গেছে। তাইতো কম হলেও ঢাকার মহল্লায় ছাই বিক্রেতারা এখনো আসে। তবে আগের চেয়ে অনেক কম।
নব্বইয়ের দশকে মিনার কার্টুনের মাধ্যমে বাথরুম করার পর হাত ধোয়ার জন্য ছাই বা সাবান ব্যবহারের আহ্বান জানানো হতো। তারপর থেকে প্রাকৃতিক কাজ সারার পর হাত ধোয়ার সময় সাবানের ব্যবহার গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। তার আগে এটা এভাবে ছিলো না।
এই অঞ্চলের মানুষ পানি দিয়ে হাত ধৌত করতো। পানি ব্যবহার না করে ব্র্যাণ্ডের স্যানিটাইজার ব্যবহার করার রীতি তেমন একটা ছিলো না। হয়তো ভ্রমণে গেলে কিংবা ছুতমার্গ আছে এমন লোকজন স্যানিটাইজার ব্যবহার করতো। খোদ ঢাকা শহরে স্যানিটাইজার কখনোই জনপ্রিয় ছিলো না। এটা গত দুই-তিন মাস আগেও অতো বিক্রি হতো না। কিন্তু করোনাভাইরাস এসে সব পাল্টে দিলো। মার্চ মাসে তো বাজারে স্যানিটাইজার পাওয়াই যাচ্ছিলো না। চাহিদা মেটাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোং পর্যন্ত স্যানিটাইজার তৈরি করছে। এবার যে অভ্যাস হয়ে গেলো, তাতে নিশ্চিত ঢাকায় স্যানিটাইজারের ভালো একটা বাজার হয়ে গেলো। কারণ মানুষ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে আমাদের অবশ্যই সাবান-পানি দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। যেখানে এগুলো ব্যবহার করা যাবে না সেখানে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। এভাবে সবাই সুস্থ থাকুন- এই কামনা করছি।
(মির্জা ইয়াহিয়া,সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জনসংযোগ ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান। সিটি ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ, এর ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া।)
