শিরোনাম

South east bank ad

শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংক খাতের সংস্কার জরুরি

 প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   ব্যাংক

শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংক খাতের সংস্কার জরুরি

দেশের ব্যাংক খাতে আগে থেকেই চরম বিশৃঙ্খলা ছিল। পাহাড়সম খেলাপি ঋণ, নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে পাচার করা, সুশাসনের চরম অভাব, কিছু ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নিয়ম-নীতি দিনকে দিন ব্যাংক খাতকে দুর্বল করে তুলেছে। এই অবস্থার মধ্যে গত এক মাসে দেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে অস্থিতিশীল পরিবেশ, সরকারের পতন এবং সরকার পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংকে মালিকানা বদলের লড়াই চলছে।

এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাতের সংকট আরও গভীর হয়েছে। এই অবস্থায় ব্যাংক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় গতি আনতে হলে দ্রুতই ব্যাংক খাতের সংস্কার করা জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তখনকার অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকার বেশ কিছু সংস্কার আনতে যাচ্ছে। পরবর্তী চারটি বাজেট ঘোষণার সময়ও তিনি এ জাতীয় সংস্কারের কথা উল্লেখ করতেন। অথচ তার মধ্যে মাত্র দুয়েকটি উদ্যোগ নামেমাত্র বাস্তবায়নের মুখ দেখেছিল। ফলে শৃঙ্খলা ফেরানোর পরিবর্তে ব্যাংকিং খাত আরও বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের সুশাসন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। তবে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সমস্যা সমাধানে এসব উদ্যোগ যৎসামান্যই।

বর্তমানে ব্যাংকিং খাত উচ্চ খেলাপি ঋণ, কিছু ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য, বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নিয়মনীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। যা এখন ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অবলোপনকৃত ঋণ ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ মোট সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এর পেছনে ছিল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়া। তারা সরকারের মদদপুষ্ট ছিল। দলীয় লোকজনকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছামাফিক নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা আনতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিতে সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যাপক অভাব ছিল। অতীতের সরকারগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করেনি। নতুন সরকারকে এগুলোতে হাত দিতে হবে। তা হলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে। কাজেই সব মিলিয়ে মানুষকে মূল্যস্ফীতি থেকে স্বস্তি দেওয়া, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারই নতুন সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন সরকারের ঘাড়ে অনেক চাপ, অনেক খাতেই তাদের সংস্কার করতে হবে। ঠিক তেমনি ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমাতে চায়, ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে কমিশন বা টাস্কফোর্স করবে, না কি বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে করাবে, তা জানাতে হবে। অর্থনীতির বাইরে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, সরকারি সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কারসহ মৌলিক বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান ঘোষণা করতে হবে।

সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা সংকট আরও বাড়িয়েছে : এদিকে সরকার পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়ও হট্টগোল হচ্ছে। গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অভিভাবকশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংক খাতে এতটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ (ইউসিবি) বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে দাফতরিক কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দুজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সামনে। ন্যাশনাল ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন কিংবা নতুন পরিচালক অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠেছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। ঋণের নামে অর্থ লোপাটের কারণে বেশিরভাগ ব্যাংকের ভিত একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। এখন সময় হলো ব্যাংক খাতকে টেনে তোলার। কিন্তু যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। আতঙ্কিত গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নিতে শুরু করলে দেশের অনেক ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি নতুন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো।

বিক্ষোভে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের দাবি হলো, ২০১৬ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের সৎ ও দক্ষ অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিপরীতে দ্রুত পদোন্নতি পেয়েছেন ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সহযোগীরা। এখন সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাংকে আর চাকরি করতে দেওয়া হবে না। আবার ২০১৬ সাল থেকে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদেরও আর ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

ব্যাংক খাতে সংস্কারের রোডম্যাপ কতটা এগুলো : দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সে পথনকশা এখন পর্যন্ত মোটামুটি ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। যদিও সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সরকার পরিবর্তনের ফলে তা থেমে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদায় সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পথনকশায় ১৭টি বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-খেলাপি ঋণ কমানো, বেনামি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, যোগ্য পরিচালক নিয়োগে ব্যবস্থা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ এবং দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, যাকে মার্জার বলা হয়। তবে এগুলোরও বাস্তবায়ন সেভাবে দেখা যায়নি। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যাংক খাত সংস্কারের এসব উদ্যোগকে যেমন বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি এ সকারকে আরও নতুন কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে ব্যাক খাতের গতি ফেরাতে-এমনটিই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

BBS cable ad

ব্যাংক এর আরও খবর: