ইসলামি ব্যাংকিংয়ে আস্থা বাড়ছে

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
ফারজানা আক্তার এক যুগের বেশি সময় ধরে স্বামীর সঙ্গে সৌদিপ্রবাসী। দেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় এবং লেনদেন করেন তারা। কিন্তু এখন ইসলামি ব্যাংকিং-এ আগ্রহ জেগেছে তাদের। তাই দেশে থাকা আত্মীয়দের মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছেন। জানতে চাইছেন, দেশে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম কিভাবে হয়।
ফারজানার মতোই ইসলামি ব্যাংকিং-এ আগ্রহ বাড়ছে অন্য অনেকের। দেশে ও দেশের বাইরে থাকা অনেকেই ঝুঁকছেন এই ব্যবস্থায়। বিশেষ করে রোজার মাসে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষের আগ্রহ বাড়ে। বিদেশে থাকা অনেকেই ফিতরার অর্থ ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এছাড়া রোজা ও ঈদ কেন্দ্র করে আর্থিক সহযোগিতা করার ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেকে। যে কারণে ইসলামি ব্যাংকিং-এ বেড়েছে হিসাব ও আমানতের পরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিদ্যমান ৬২টি ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩৪টি বিভিন্নভাবে শরিয়াহভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছে।
২০২১ সালে করোনা সংকটের বছরেও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারার ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে মোট আমানতের প্রায় ২৮ শতাংশ। বিতরণ করা ঋণের সাড়ে ২৭ শতাংশের বেশি এ খাতের ব্যাংকগুলোর। প্রবাস আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ আসছে এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৮৩ সালে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে। এরপর নতুন পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক যেমন এসেছে, তেমনি প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং শাখা চালু করেছে। আমানত সংগ্রহ, শিল্প-ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় সংগ্রহে শরিয়াভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু। তারা সুদভিত্তিক কারবারের পরিবর্তে শরিয়াহভিত্তিক কারবারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এজন্য আমানতকারীরা দর-কষাকষি করেন না। তাদের বেশিরভাগ আবার একটি ব্যাংকে আমানত রেখেই সন্তুষ্ট থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে যাচ্ছে। কারণ ইসলামি ব্যাংকগুলোতে স্বেচ্ছায় অনেক আমানত আসে। এই ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড কম। আবার রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয় বেশি। এসব কারণে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ঝোঁক বাড়ছে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাহকরা এখন ইসলামি ব্যাংকিং বেশি পছন্দ করছে। মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অনেক মানুষ সুদের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। ইসলামি ব্যাংকিংয়ে আস্থা পান তারা। এজন্য এই খাতের ব্যাংকগুলোর আমানত টার্গেট দ্রুত পূরণ হয়। আবার এদের মাধ্যমে রেমিট্যান্সও আসে বেশি।
‘গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে অনেক তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকও ইসলামি ব্যাংকের দিকে যাচ্ছে। আবার প্রতিটি ব্যাংক এখন ইসলামি উইন্ডোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। এজন্য ইসলামি ব্যাংকের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে।’
দেশে ইসলামি ব্যাংকের সংখ্যা কত
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুসারে, দেশে ১০টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং করছে। এগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি, ফার্স্ট সিকিউরিটি, শাহজালাল, ইউনিয়ন, এক্সিম, আল-আরাফাহ, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড ও গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক (সাবেক এআরবি গ্লোবাল)।
এসব ব্যাংকের শাখার সংখ্যা এক হাজার ৬৭১টি।
প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৯টির ৪১টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। এগুলো হলো- দ্য সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথ ইস্ট, যমুনা, ব্যাংক আল ফালাহ ও এনআরবিসি।
১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের রয়েছে ৩৬৮ ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো। এগুলো হলো- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী, ট্রাস্ট, ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, এনআরবিসি, ওয়ান, ইউনাউটেড কর্মাশিয়াল, মেঘনা ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট। ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনায় ব্যাংকগুলোতে ৪৫ হাজার ২৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
আমানতে শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক
২০২১ সাল শেষে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ৬৬ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংকে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা, উইন্ডোসহ আমানত দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। এই অঙ্ক পুরো আমানতের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের আমানত ছিল ৩ লাখ ২৬ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।
আমানত সংগ্রহের দিক থেকে সবার শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির মোট আমানত ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ৩৫ দশমিক ১৮ শতাংশ একাই সংগ্রহ করেছে ব্যাংকটি।
আমানত সংগ্রহের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক (১১ দশমিক ৯৩), এক্সিম (১০ দশমিক ৭৫), আল-আরাফাহ (৯ দশমিক ৬৬), সোশ্যাল ইসলামি (৮ দশমিক ৫২), শাহজালাল (৫ দশমিক ৫৩), ইউনিয়ন (৫ দশমিক ০৯), স্ট্যান্ডার্ড (৪ দশমিক ২৪), গ্লোবাল ইসলামি (৩) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক (দশমিক ৩৩ শতাংশ)।
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের আমানত রাখার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মুদারাবা আমানত সবচেয়ে বেশি, ৪৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে মোট আমানতের ২ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং উইন্ডোগুলোতে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ আমানত রয়েছে।
বিনিয়োগ
২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ধারার ১০ ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫৯ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বিতরণ করে শীর্ষে আছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ।
এর পর রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি (১২ দশমিক ৮৪), এক্সিম (১১ দশমিক ৭৫), আল-আরাফাহ (৯ দশমিক ৪১), সোশ্যাল ইসলামি (৮ দশমিক ৭১), শাহজালাল (৬ দশমিক ১৩), ইউনিয়ন (৫ দশমিক ৪৮), স্ট্যান্ডার্ড (৪ দশমিক ৬৪), গ্লোবাল (৩ দশমিক ০৩) এবং আইসিবি ইসলামিক (দশমিক ২৪) শতাংশ।
‘বাই মুরাবাহ’ পদ্ধতিতে বেশি বিনিয়োগ
ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘বাই মুরাবাহ’ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। মোট বিনিয়োগের প্রায় ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ করা হয়েছে এ পদ্ধতিতে। এরপর রয়েছে ‘বাই মুয়াজ্জল’। এ ব্যবস্থায় বিনিয়োগের পরিমাণ মোট বিনিয়োগের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। বাকি বিনিয়োগ করা হয়েছে বাই সালাম, ইজারা অ্যান্ড ইজারা, বাই ইসতিসনা, মুসারাকাসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ বেশি
ইসলামি ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে, ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে শিল্প খাত, ২৮ দশমিক ০৬ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা কটেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
এ ছাড়া অবকাঠামোতে ৬ দশমিক ৪২, বৃহত্তর ও সেবা বাণিজ্যে ৫ দশমিক ৪৮, কৃষিতে ১ দশমিক ৮১, ভোক্তা খাতে ১ দশমিক ৭৯ ও যোগাযোগ খাতে ১ দশমিক ০২ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে ইসলামি ব্যাংকগুলো।