হুমকির মুখে রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধ
আমজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী ব্যুরো) :
পরম মমতায় পদ্মাপাড়ের রাজশাহী শহরকে যুগ যুগ ধরে আগলে রেখেছে টি-বাঁধ (শহররক্ষা বাঁধ)। তবে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই শহররক্ষা বাঁধটি প্রতিবছর বন্যার সময় হুমকির মুখে পড়ে। সবুজে ঘেরা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাজশাহী শহরকে র্কীতিনাশা পদ্মার গর্ভে বিলীন হতে না দেয়া একমাত্র এই বাঁধটি রক্ষায় স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর এ কারণেই বছরের পর বছর এটি রক্ষার নামে বন্যার সময় হাজার হাজার জিও ব্যাগ ফেলে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির উদ্যোগ বাড়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে রাজশাহীতে পদ্মার কোল ঘেঁসে থাকা বন্যা নিয়ন্ত্রণ (শহররক্ষা) বাঁধে ছোট-বড় সবমিলিয়ে বর্তমানে ৫৮০টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। অথচ দুই-এক বছর পর পর এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানালেও কখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির প্রতিনিয়ত ক্ষতিসাধন হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় টি-বাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে সর্বনাশা পদ্মাগর্ভে দেশের প্রাচীন এই ছিমছাম শহরটি বিলীন হতে পারে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- ‘সায়েন্টিফিক স্টাডি’র মাধ্যমে শহর রক্ষার স্থায়ী সমাধান এখন অতিব জরুরি পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়- চলতি মাস আগস্টের শুরু থেকেই পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টে পানি বাড়তে থাকে। গত ২১ আগস্ট বর্ষা মৌসুমে রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৮৫ মিটার। যা বিপদসীমার (রাজশাহীতে বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০) মাত্র ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। চলতি মাসে পানি বৃদ্ধির পর থেকে টি-বাঁধের হুমকি মোকাবেলায় এর আশেপাশে দু’দফায় ১৪ হাজার বালির বস্তা (জিও ব্যাগ) ফেলা হয়েছে। আর প্রতিটি বালির বস্তার দাম ৪৫১ টাকা। সেই হিসেবে- এবার এখন পর্যন্ত ৬৩ লাখ ১৪ হাজার টাকার বালির বস্তা টি-বাঁধ রক্ষায় এর আশেপাশে ফেলা হয়েছে। তবে টি-বাঁধে এবার ১৬ হাজার বালির বস্তা ফেলার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত বালুর বস্তা পদ্মার জ¦লে ফেলা হবে বলে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এভাবেই প্রতিবছর টি-বাঁধ রক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা পদ্মার পানিতে ফেলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এভাবে প্রতিবছর বালুর ফেলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা হচ্ছে। বর্ষার সময় জরুরিভাবে এসব বালুর বস্তা না ফেললেও শহররক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়ে। তবে প্রতিবছর বালুর বস্তা না ফেলে এর স্থায়ী একটা সমাধান জরুরি বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন- নদীর জ¦লে তাৎক্ষণিকভাবে কত বস্তা বালু ফেলা হচ্ছে সেটি সংশ্লিষ্টরা ছাড়া কেউ জানে না। এতে তাদের দুর্নীতি করারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশিষ্ট ভূ-বিজ্ঞানী ও রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন- ‘রাজশাহী শহরের যে এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই জায়গাগুলো স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সায়েন্টিফিট স্টাডিতে নিয়ে এসে স্থায়ী একটা সমাধান করা জরুরি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা অসুখ হলে শুধু ওষুধ দিচ্ছে অর্থাৎ বর্ষার সময় তড়িঘড়ি করে জিও ব্যাগ ফেলে টি-বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে। অপরিকল্পিতভাবে এভাবে প্রতিবছর পানিতে বস্তা ঢেলে দেওয়ায় শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো- সংশ্লিষ্ট যারা পদ্মায় বস্তা ফেলছেন তারা যদি ৯ হাজার বস্তা ফেলে ১২ হাজারের হিসেব দেয় তাহলে কারও কিছু বলার নেই। এজন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সায়েন্টিফিট স্টাডির মাধ্যমে কী করলে এর স্থায়ী সমাধান করা যায় সেটিই করতে হবে। অন্যথায় প্রতিবছর অপরিকল্পিতভাবে এই কাজ চলতেই থাকবে।’
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- উন্নয়ন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় টি-বাঁধ রক্ষায় স্থায়ী কোনো সমাধান সম্ভব হয় না। রাজশাহী পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম শেখ বলেন- ‘ব্লক দিয়ে স্থায়ীভাবে কাজ করতে যে টাকা দরকার সেই বরাদ্দ আমাদের উন্নয়ন বাজেটে থাকে না। উন্নয়ন বাজেটে যে টাকা শহররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকে সেটিই সময় মত দেয়া হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘টে-ার করে ইউনাইটেড ব্রাদার্স নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদ্মায় বালির বস্তা ফেলার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। এবছর এই প্রতিষ্ঠানটি দুইটি প্যাকেজে বস্তা ফেলার কাজ করেছে। এই টাকা ঠিকাদারদের পুরোপুরি পরিশোধ করতে তিন বছর সময় লেগে যাবে। তবে ব্লক দিয়ে স্থায়ী কাজ করার জন্য ইতোমধ্যেই কারিগরি কমিটির মাধ্যমে একটি ডিডিবি প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তবে একটি ডিডিবি পাস হতে অন্ততপক্ষে ২ বছর সময় লাগবে। এটি পাস হয়ে গেলে তখন স্থায়ীভাবে কাজ করা যাবে।’
বর্ষাকালেই কেন বালির বস্তা ফেলে শহর রক্ষা বাঁধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয় এর জবাবে তিনি বলেন, ‘শহররক্ষা বাঁধের প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণে কাজ করা হয়। এই তীরে অর্থাৎ উজানে রয়েছে ৫টি স্পার এবং ভাটিতে ৩টিসহ মোট ৮টি স্পার। এর মধ্যে উজানের ৫টি স্পারের মধ্যে টি-বাঁধ ও আই-বাঁধ রয়েছে। তবে এসব স্পারে আসলে স্পার্কিং হচ্ছে কিনা তা বর্ষাকাল ছাড়া বুঝা যায় না। এজন্য শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষায় শুধু বর্ষকালে বালুর বস্তা ফেলা হয়।’ আর শুষ্ক মৌসুমে এসব বাঁধ রক্ষায় কেন উদ্যোগ নেয়া হয় না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে তো পানি থাকে না। পানি না থাকলে তো স্পার্কিং হয় না। স্পার্কিং না হলে তো আসলে বুঝা যাবে না যে, কোনটাতে কাজ করা প্রয়োজন আর কোনটিতে নেই।’
এদিকে রাজশাহী নগরীর শ্যামপুর থেকে পবা উপজেলার হরিপুর পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর স্থানীয় প্রভাবশালীরা ৫৮০টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুললেও সেগুলো উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে- অবৈধ এসব স্থাপনার মধ্যে দোকান/মুদির দোন রয়েছে ৮৬টি, চায়ের দোকান ৮২টি, গরুর গোয়াল/মুরগির খামার ২৮টি; পাকা, সেমি পাকা ও কাঁচাঘর রয়েছে ৯০টি; পাকা, সেমিপাকা, টিনশেড, মাটির ও কাঁচা বাড়ি রয়েছে ১৩৬টি, মাজার/মসজিদ রয়েছে ৫টি, পানের ঢোপ/পানের দোকান ৩৪টি; সেলুন ৮টি; সিটি কর্রোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের একটি কার্যালয়সহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের ক্লাবঘর, চেম্বার, দলীয় কার্যালয় রয়েছে ২৫টি; প্রাচীর/বারান্দা ২৩টি; ফ্লেক্সিলোড, ইলেকট্রোনিক্স মেকানিক্যাল দোকান রিকশা/সাইকেল গ্যারেজ রয়েছে ১৬টি; খাবার হোটেল ১৪টি; রুটি/ফুচকা/চটপটির দোকান রয়েছে ১৫টি; ১৪টি রান্নাঘর; দর্জির দোকান ৩টি এবং ১টি শহীদ মিনার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ এসব স্থাপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রাজশাহী পাউবো কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। দুই/এক বছর পর পর এভাবে জেলা প্রশাসনে শুধু চিঠিই দেয়া হয়। কিন্তু অবৈধ এসব স্থাপনা উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এসব স্থাপনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
অবৈধ এসব স্থাপনার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিল বলেন, ‘অবৈধ এসব স্থাপনার অধিকাংশ জায়গা নিয়ে হাইকোর্টে রিট চলছে। আমরা চেষ্টা করছি- হাইকোর্ট থেকে এই রিট ভ্যাকেট করার। রিট ভ্যাকেট হয়ে গেলেই আমরা অবৈধ এসব স্থাপনা উচ্ছেদে মাঠে নামবো।’