সরকারী খনন করা খালে ক্রাউন উল কারখানার দখলবাজী
ফয়সাল আহমেদ, (গাজীপুর) :
গাজীপুরের শ্রীপুরে সরকারী লবলঙ্গ খাল দখল, গতিপথ পরিবর্তন ও খাল পাড়ের মাটি কেটে কারখানা এলাকার সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন ভরাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে ক্রাউন উল ফ্যাশন নামের একটি কারখানার বিরুদ্ধে। চলতি বছরই পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারী খাল, বিল, নদী পূর্ণখনন প্রকল্পের আওতায় এ খালটি খনন করে পানি প্রবাহ তৈরী করেছিল। যদিও সরকারী খালে দখলবাজী করায় খননের সরকারী টাকা জলেই চলে গেল।
কারখানাটি বেশ কিছুদিন ধরেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খালের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় দখলযজ্ঞ ও ধ্বংসের প্রক্রিয়া চালালেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, লবলঙ্গ খালের এক পাড় দখল করে পৌর এলাকার কেওয়া মৌজা ও মাওনা ইউনিয়নের রাথুরা মৌজায় এই কারখানাটি গড়ে উঠেছে। সরকারী বিধি অনুযায়ী খালের পূর্ব পাড়ে বেশ কিছু জায়গা দখল করে কারখানা কর্তৃপক্ষ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দখল করে নেন। খালের অধিকাংশ অংশই ভরাট হয়ে পড়ে। পরে বিগত অর্থবছর সরকারের খাল, বিল নদী পূর্ণ খননের অংশ হিসেবে মাওনা- কালিয়াকৈর সড়কের লবলঙ্গ ব্রিজ থেকে খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে খালটি তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। তবে পানি আইন অনুযায়ী উক্ত কারখানার সীমানাপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশনা থাকায় ভিন্ন পথে হাঁটেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। তারা খালের গতিপথ পরিবর্তন করে নিজেদের উদ্যোগে খাল খনন শুরু করেন। এর একপাড়ের মাটি দিয়ে অপর পাড়ের একটি অংশ ভরাট করে জমিতে রুপান্তরের কাজ শুরু করেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য, বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানি মাটির নিচে খনন করে তা পাইপের মাধ্যমে খালে ছেড়ে দিয়েছে। এতে খালের বিভিন্ন জলজ প্রাণী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ইতিপূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কয়েকবার এই কারখানার বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানা করেছিল।
মাওনা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, রাথুরা মৌজার সিএস ২নং দাগের খালের বেশ কিছু অংশ কারখানা কর্তৃপক্ষ খনন করছেন। তারা তাদের ইচ্ছেমতো গতিপথ পরিবর্তন করেছেন। খালের মাটি সরিয়ে তাদের একটি অংশ ভরাট করছেন। কিন্তু সরকারী অনুমতি ছাড়া এভাবে ইচ্ছেমতো খাল খনন পুরোপুরি বিধিবহির্ভূত।
নদী, খাল ও বিল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে নদী পরিব্রাজক দল নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির শ্রীপুর উপজেলা শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, এক সময়ে দেশীয় মাছের যোগান দিতো এই লবলঙ্গ খাল। এই খাল কেন্দ্রিক চলতো এদেশের জীবন-জীবিকা, কৃষকের পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই খালের। শিল্পাঞ্চল খ্যাত এ উপজেলায় খাল কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানা। দীর্ঘ এখালটিকে কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান অন্যায় ভাবে গলা চেপে ধরেছে। যার যার ইচ্ছা মতো ব্যবহার করছে। কারখানার বর্জ্যের কেমিক্যাল যুক্ত দূষিত পানি খালে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী কেউই খাল ও জলাভূমির গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবে না। সবচাইতে আশাহত বিষয় হলো ক্রাউন উল নামের কারখানাটি আইন না মেনে খালের গতিপথ পরিবর্তন করে এক পাশের মাটি এনে অপর পাশে ফেলছে। প্রশাসন যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয় তাহলে অচিরেই খালটি অস্তিত্ব সংকটে বিলীন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, জলাধার আইন ২০০০ অনুযায়ী নদী-খাল ও জলাধারের গতিপথ পরিবর্তন করার অধিকার কেউ রাখে না। পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী নদী-খাল ও জলাধার থেকে ১০মিটার করে ফোরশোর রেখে নির্মাণ কাজ করতে হবে। কিন্তু নিয়ম না মেনে যদি কারখানার কর্তৃপক্ষ তাদের কাজ চলমান রাখে তাহলে স্থানীয় প্রশাসন এ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেন।
খাল দখল বা গতিপথ পরিবর্তন করা হয়নি বলে কারখানার মহা-ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম ভুইয়া বলেন, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খালকে তার প্রকৃত রূপে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েই খালের উভয় পাশেই কারখানার জমি, আমরা খালকে খালের জায়গাতে রেখেই কাজ করা হচ্ছে।
এবিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উজ্জল কুমার হালদার বলেন, এক নির্দেশনা মোতাবেক সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খাল প্রবাহিত হবে। খাল খননের বিষয়টি জানার পরপরই একজন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার উপজেলা ভূমি অফিস থেকে সার্ভেয়ার একটি দল পাঠানো হবে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যে প্রতিবেদন দিবেন, সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সরকারী পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, এই কারখানার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযান করে পরিবেশ আইন ভঙ্গ করায় আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল। কারখানা কর্তৃপক্ষ সরকারী খালের পাড় দখল করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করায় তাদের সীমানাপ্রাচীর সরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল। তবে এ বিষয়টি দেখবে স্থানীয় প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, কয়েক মাস আগে খালের ওই জায়গায় সীমানা নির্ধারণ করে খালটি খনন করে পানি প্রবাহ সচল রাখা হয়েছে। কারখানার কর্তৃপক্ষ খালটি পুনরায় খনন করে নিয়মবর্হিভূত কাজ করেছে। তাদের খাল খনন করার কোন এখতিয়ার নেই। বিষয়টি গাজীপুর জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে ঘটনাস্থলে এক প্রকৌশলীকে পাঠানো হবে।