ভারতে স্মার্টফোন সরবরাহ কমেছে ৪৮%
কভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন, আমদানি-রফতানি থেকে শুরু করে ভোক্তা চাহিদায় বড় ধস নেমেছে। মরণঘাতী ভাইরাসটির দ্রুত প্রসারের ফলে শুরুর দিকে ঘরবন্দি থাকে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া এ সময় অন্য পণ্য ক্রয় থেকে যথাসম্ভব দূরে থেকেছে মানুষ। একই কারণে প্রযুক্তি পণ্যেরও চাহিদা ব্যাপক হারে কমেছে। বিশেষ করে স্মার্টফোনের বেচাকেনায় বড় ধস নামিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। উদ্ভূত এ মহামারী পরিস্থিতিতে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ স্মার্টফোন বাজার ভারতের স্মার্টফোন সরবরাহ ৪৮ শতাংশ কমেছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রযুক্তি বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ক্যানালিসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। খবর ইটি টেলিকম ও টেক ক্রাঞ্চ।
ক্যানালিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ভারতের স্মার্টফোন সরবরাহ এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ৪৮ শতাংশ কমেছে। এ সময় দেশটিতে স্মার্টফোন সরবরাহ ১ কোটি ৭৩ লাখ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে। যেখানে গত বছরের একই সময়ে দেশটিতে স্মার্টফোন সরবরাহ হয়েছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৫ লাখ ইউনিট।
প্রযুক্তি বাজার বিষয়ে তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময়ে স্মার্টফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অতিমন্দার মুখোমুখি হয়। সরকারের কঠোর নির্দেশনায় এ সময় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। বন্ধ থাকে সরবরাহ কার্যক্রমও। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের সবধরনের বিক্রেতাও এ সময় বিক্রি থেকে দূরে থাকে। ফলে একদিকে যেমন সরবরাহ কমে আসে, একই সঙ্গে স্মার্টফোনের চাহিদায়ও এ সময় বড় ধস নামে।
তবে এ সময় ভারতের স্থানীয় উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়লেও শাওমি, অপোর মতো ব্র্যান্ডগুলো চাহিদা মোকাবেলায় আমদানি করতে বাধ্য হয়। ভারতে লকডাউন চললেও এ সময় দেশটির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা চীনা ব্র্যান্ড শাওমি ৫৩ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন রফতানি করেছে। ২০১৮ সালের পর থেকে দেশটির বাজারে কার্যক্রম শুরু করা শাওমির এ সময় ডিভাইস সরবরাহে হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে ভারতের স্মার্টফোনের বাজারে ২১ দশমিক ৩ শতাংশ হিস্যা নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকা ভিভো এ সময় রফতানি করেছে ৩৭ লাখ ইউনিট। দেশটির বাজারে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং। ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ হিস্যা নিয়ে অবস্থান করা স্যামসাং এ সময়ে রফতানি করেছে ২৯ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন। ভিয়েতনামের বাইরে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় প্লান্ট ভারতে। তবে এ সময় প্রতিষ্ঠানটি স্মার্টফোন সরবরাহে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে।
চীনা স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অপো এ সময় ২২ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন সরবরাহ করে ভারতের চতুর্থ স্মার্টফোন সরবরাহকারীর জায়গা দখলে নিয়েছে। এর পরই রয়েছে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান রিয়েলমি। প্রতিষ্ঠানটি এ সময় সরবরাহ করেছে ১৭ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন।
ভারতে স্মার্টফোন সরবরাহে সবচেয়ে কম প্রভাব পড়েছে মার্কিন জায়ান্ট অ্যাপলের ওপর। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অ্যাপলের সরবরাহ কমেছে ২০ শতাংশ। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি আড়াই লাখের বেশি ইউনিট স্মার্টফোন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের শেষের দিকে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করে নয়াদিল্লি। এ সময় নিত্যপণ্যের দোকান এবং ফার্মাসি বাদে প্রায় অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন এবং দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। এমনকি অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ সময় স্মার্টফোন থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনের বাইরের পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করে সরকার।
দীর্ঘ লকডাউনের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে লকডাউন শিথিল হতে শুরু করে। ফলে এরপর থেকেই মূলত ভারতের বাজারে স্মার্টফোনগুলো আবার তাদের কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু করেছে। সম্প্রতি দিনগুলোতে দেশটির প্রায় অধিকাংশ স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন হ্যান্ডসেট বাজারে আনতে শুরু করেছে। মূলত লকডাউন চলাকালে বাজারে মন্দা অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যই এ ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া আসন্ন দিনগুলোতে আরো নতুন স্মার্টফোন ভারতের বাজারে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের স্মার্টফোনের বাজারে নেতৃত্ব দেয়া কিছু নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য এখন কেবল মহামারী ভাইরাসই হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে না। বরং এসব ব্র্যান্ডের জন্য আরো খারাপ সময় নিয়ে আসতে পারে সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব। বিশেষ করে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য সামনের দিনগুলোতে বেশ বাজে সময় আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সীমান্ত ইস্যুতে চীনবিরোধী মনোভাব এখন ভারতীয়দের মাঝে বেশ দৃশ্যমান। এ অবস্থায় চীনা পণ্যের বয়কটের ডাক আসছে দেশজুড়ে, যা দেশটির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা শাওমি, ভিভো, অপো ও রিয়েলমির মতো ব্র্যান্ডগুলোর জন্য এখন মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
ক্যানালিসের বিশ্লেষক অ্যাডওয়েট মারডিকার মনে করেন, সময়টা এখন মোটেই চীনা স্মার্টফোন বিক্রেতা ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নেই। তিনি বলেন, ভোক্তাদের মাঝে সরাসরি চীনবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। এছাড়া সরকারও এখন চীনা পণ্যের বাইরে গিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দৌড়ে ঝুঁকছে। ক্রেতাদের মধ্যেও এখন ইন্ডিয়া ফার্স্ট নীতি
প্রবল হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক শাওমি, ভিভো, রিয়েলমি ও অপোর বিকল্প হিসেবে নকিয়া, স্যামসাং বা অ্যাপল রাতারাতি জায়গা নিতে পারবে না। কারণ চীনা পণ্যের দামের প্রতিযোগিতায় আপাতত এসব ব্র্যান্ডকে হার মানতে হবে।