গণমাধ্যমকর্মীদের অভিভাবক কে?

মঞ্জুরুল আলম পান্না
‘দায়িত্বের প্রতি সচেতন থেকে একজন শ্রমিক মাসের পর মাস কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু মাসের পর মাস তার বেতন-ভাতা বকেয়া রাখছেন মালিক। বিশেষ প্রয়োজনে বকেয়া পড়ে থাকা টাকার ন্যূনতম কিছু অংশ চাইতে গেলেও মিলছে না, উপরন্তু বেশি কথা বলছেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। উপায়ন্তর মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবারও কাজে মনোনিবেশ। ঘরে অসুস্থ শিশু সন্তান। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। আবারও দ্বারস্থ মালিকের। তবু মন গলে না কর্তৃপক্ষের। অসুস্থ সন্তানের সামনে পিতার ছটফটানী। এক সময় উপলব্ধি হয়, প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানের দেহখানি নিথর হয়ে গেছে। বাবার ওপর অভিমান করে খুব নিরবে কখন যেন শেষ বিদায় নিয়ে নিলো অবুঝ শিশুটি! কাঁদবারও যেন শক্তি থাকে না সন্তানের চিকিৎসা করাতে অক্ষম বাবার। কোন কারণে কাঁদবে? নিজের অক্ষমতার জন্য, নাকি সন্তান হারানো কষ্টের জন্য’! এটা কোনো গল্প নয়। ‘বিশ্বজুড়ে বাংলা’ শ্লোগানকে সামনে নিয়ে সবেমাত্র প্রচারে আসা একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন হতভাগা ক্যামেরাম্যানের জীবনের বাস্তব চিত্র এটি। চ্যানেলটি সম্প্রচারে আসতে না আসতেই বেতন-ভাতা বকেয়া হতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক সাংবাদিক, প্রযোজক, কলা কুশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের। দুই দুটো ঈদ চলে গেলেও কাউকে দেওয়া হয়নি কোনোপ্রকার বেতন-ভাতা-বোনাস। তাতে মালিকের কী এসে যায়! তাদের তো আর গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই। কর্তৃপক্ষের মিথ্যে আশ্বাসে একে একে জমা হয়ে যায় তিন মাসের বেতন-ভাতা। এরই মধ্যে আরেক ক্যামেরাম্যান ভাড়া দিতে না পারায় তাকে ঘর থেকে জোর করে নামিয়ে দেন বাড়ির মালিক। সেই ক্যামেরাম্যান ওই টেলিভিশন কার্যালয়ের মধ্যেই দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক করেন। সংসার খরচ চালাতে না পেরে প্রতিষ্ঠানটির স্টাফদের অনেকে বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ওই টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মীরা মালিককে অবরুদ্ধ রেখে প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হোন, শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন কার্যালয়ের বাইরে। গভীর রাতে দুই মাসের সময় হাতে নিয়ে মালিকপক্ষ থেকে দেওয়া পে-চেক দেওয়া হলে শান্ত হন বিক্ষুব্ধ কর্মীরা। একই সঙ্গে তাদের অনেকে আবার মৌখিকভাবে চাকরিতে ইস্তফাও দেন ততক্ষণাৎ। না দিয়েও বা উপায় কী? তারা খুব ভালোভাবেই জানেন ওই প্রতিষ্ঠানে তারা আর নিরাপদ নন। বরখাস্তের খড়গ যেকোনো সময়ের জন্য ঝুলছে মাথার ওপর। অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেলে এমন ঘটনা তো এখন নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার। আমি নিশ্চিত ‘বিশ্বজুড়ে বাংলা’ শ্লোগানধারী ওই চ্যানেলের শ্রমিক অধিকার বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় কেবল গণমাধ্যমকর্মী হওয়ার কারণেই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের পাওনা আদায়ের চেষ্টা করেছেন। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান হলে এমন ধরণের ঘটনায় হয়তো আরও অনেক বেশি কিছু হয়ে যেত। আর তখন হয়তো সব সংবাদমাধ্যমেই তা গরম খবর হয়ে উঠত। অবাক হওয়ার বিষয় হাতে-গোনা তিন-চারটি গণমাধ্যম ছাড়া আর কোথাও বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনার কোনো সংবাদ হলো না। এদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে যত ধরনের সমস্যা নিয়ে লেখা বা সংবাদ প্রচার হয় তার মধ্যে সম্ভবত গণমাধ্যম কর্মীদের কষ্ট-দুর্দশার খবর সবচেয়ে কম লেখা বা প্রচার হয়। সাংবাদিক নেতারাও ব্যস্ত অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ইস্যু নিয়ে। গণমাধ্যমকর্মীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার সময় কোথায় তাদের!
কদিন আগেই সকালের খবর নামে একটি পত্রিকার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে নিলো কর্তৃপক্ষ। বেকার হয়ে পড়লেন কয়েকশত কর্মী। সামনে তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এ ধরনের উদাহরণ আমাদের সামনে কম নেই, আবার প্রতিকারের পথও খুব একটা নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেভাবে একের পর এক টেলিভিশন চ্যানেল আর পত্রিকার লাইসেন্স তুলে দেওয়া হচ্ছে অদক্ষ অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে, তাতে গণমাধ্যমের চরিত্র বলে কিছু থাকছে না। এর খেসারত সম্ভবত পুরো সমাজকেই দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক