শিরোনাম

South east bank ad

করোনা পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে মহামন্দা

 প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২০, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

মর্তুজা মিশু: মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। তবে ঠিক কীভাবে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেরনি বিশেষজ্ঞরা।দীর্ঘ ২ মাস করোনা যুদ্ধ শেষে চীন ইতোমধ্যে করোনামুক্ত উৎসব করেছে। চীন করোনা মুক্ত হলেও ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু থেমে নেই। করোনা তার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এতোটা প্রযুক্তিনির্ভর ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে শক্তিশালী দেশ এই একটি মাত্র ভাইরাসের কাছে কুপোকাত। প্রতিদিন সারা বিশ্বে পরিসংখ্যান অনুযায়ী মারা যাচ্ছে ৫-৭হাজার লোক আর পরিসখ্যান এর বাহিরের হিসেব নাইবা টানলাম। ইউরোপ আমেরিকায় করোনা এতোটা প্রকোট আকার ধারন করার মূলে ছিলো অসচেতনতা। তার কোয়ারেন্টাইন মানেনি, লকডাউন করতে কাল ক্ষেপণ করেছে আর এখন ভুলের খেসারত দিচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ সহ দক্ষিন এশিয়াতে এখনো অতোটা শক্তি সঞ্চার করতে না পারলে এপ্রিলে এটা তান্ডব চালাতে পারে বলে অনেকেই ধারনা করছেন। বাংলাদেশে ২৫ ই মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারন ছুটি বলবৎ আছে। দোকান পাট বন্ধ। তাছাড়া গার্মেন্টস গুলোও ছুটি দিয়ে দিয়েছে সরকার। পরিসংখ্যান অনুসারে এখন পর্যন্ত এখানে মারা গেছে ৩০ জন আর আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮২জন। আগামী একসপ্তাহ দক্ষিন এশিয়ার জন্য খুবই ক্রুশল মোমেন্ট। এই সময়ে সবাইকে আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে। সবাই ইতোমধ্যে কোয়ারেন্টাইনে থেকে যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছে। আগামী কয়েকদিন তাই সবাই আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে। অর্থনীতিবিদ্যা অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ধীর গতি অথবা বাণিজ্যিক আবর্তন-এর সংকোচনকে মন্দা বলা হয়। মন্দার সময় বড় অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ধরন একই রকম থাকে। মন্দার সময়, জাতীয় গড় আয় (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা GDP), চাকরি, বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়, উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার, পারিবারিক আয়, ব্যবসায়িক লাভ এবং মুদ্রাস্ফীতি, এ সব কিছুই অনেক কমে যায়। এই সময় কোম্পানীগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং বেকারত্বের হার বেড়ে যওয়ার প্রকোপ দেখা যায়। IMF-এর বক্তব্য অনুসারে বিশ্বের বিকাশ যখন ৩% এর কম, তখন সেই পরিস্থিতিকে বিশ্বব্যাপী মন্দা বলা যায়।IMF-এর আনুমানিক হিসেব অনুসারে ৮ থেকে ১০ বছরের এক-একটি চক্র অন্তর বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেয়। গত তিন দশক ধরে IMF যে তিনটি মন্দাকে বিশ্বব্যাপী মন্দা আখ্যা দিয়েছে, সেই ক্ষেত্রগুলোতে বিশ্ব জুড়ে মাথাপিছু উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য বা ঋণাত্মক । ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (IMF)-এর অর্থনীতিবিদেরা বলেন বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বিশ্বের বিকাশের হার তিন শতাংশ বা তারও কম হবে। এই মান অনুসারে ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি সময়সীমা উপযুক্ত বলে চিহ্নিত হয়েছে: ১৯৯০-১৯৯৩, ১৯৯৮, ২০০১-২০০২ এবং ২০০৮-২০০৯। অার এবারকার সময়সীমা ২০১৯-২০২০। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি মন্দা কি বা কেমন। এখন দেখা যাক মন্দার প্রভাব টা কেমন হতে পারে। মন্দার প্রথম প্রভাব হলো ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা তির্যক ভাবে কমে যাবে। অফিস আদালতে চলবে কর্মী চাটাই এর মহড়া। এতোমধ্যে করোনা আক্রান্তের আগে স্টান্ডার্ড চাটার্ড এর মতো নামি ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্র তাদের কয়েকলাখ কর্মী চাটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া বিশ্ব মন্দার আরেকটি বড় কারন হতে পারে ফার্নেস অয়েল সহ সকল ধরনের জ্বালানীর দাম কমে যাও। বিশ্বে কম বেশি ৫০ টি দেশর অর্থনীতি তেল নির্ভর। বিশেষ করে তেলের দাম কমে যাওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রকোট প্রভাব দেখা দিতে পারে। করোনার ফলে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে যেটা মন্দায় দ্বিগুন গতি আনতে পারে। কৃষক উৎপাদন করবে ঠিকই কিন্তু ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারনে পন্য দাম হারাবে, কৃষক হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাছাড়া সরকার বাজেট অন্য ক্ষেত্রে বাড়িয়ে করলেও করোনার কারনে বাজেটের বড় অংশ চলে যাচ্ছে চিকিৎসা খাতে আর এর প্রভাবে শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন সহ অনেক খাতে স্থবিরতা নিয়ে আসবে। তাচাড়া বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারে বড়রকমের মূল্য সংশোধন বা সূচক হারিয়েছে। অর্থনৈতিক ধ্বস বা মহামন্দার একটা অন্যতম ইঙ্গিতদাতা শেয়ার বাজার। যেহেতু, মন্দার কারনে কর্মী চাটাই হতে পারে তাই রেমিট্যান্স নির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে বিশেষ করে বাংলাদেশে, ভারত, পাকিস্তান সহ দক্ষিন এশিয়ায়। করোনার ফলে বেশির ভাগ দেশই লকডাউন। সো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবকিছু সচল হয়ে গতি আসতে কম বেশি ৩ মাস সময় লেগে যাবে এক একটি দেশের। আর এই ত্রৈমাসিক অর্থনৈতিক রুগ্নতার কারনেই একটা দেশকে মন্দায় পড়তে হয়ে বলে অর্থনীতিবিদ, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম ধারনা দিয়ে আসছেন। থমাস শেফার- জার্মানরর অর্থমন্ত্রী যিনি কিনা করোনা প্রভাবের পর অর্থনীতির অবিস্থা কি দাঁড়াবে, সেই দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর লাশ রেল লাইনের উপর পাওয়া গিয়েছে। জানি না আমাদের অবস্থা কি হবে। এই বৈশ্বিক ধ্বস আমরা সামাল দেবো কিভাবে? আমাদের অর্থনীতি প্রথমত রেডিমেড গার্মেন্টস রপ্তানি নির্ভর। আমাদের বৈদেশিক আয়ের বেশির ভাগ ই আসে এই আরএমজি খাত থেকে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান ক্রেতা। একক ভাবে এই দেশ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি আয় করি। তাছাড়া তারা করোনায় বিপর্যস্ত প্রায়। এই বিপর্যস্ত পরিস্তিতি আরো প্রসারিত হতে পারে সেখানে। তাই তাদের মন্দার ফলে বিলাসীতায় বাজেট কমবে আর সেই প্রভাব পড়বে আমাদের উপর। একর্ড( ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট) ইতোপূর্বে আমাদের এই বৃহৎ শিল্পের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্নতুলেছে। আর এখন করোনা আক্রান্তের ফলে তাদের বেশির ভাগ দেশই লকডাউন। ইউরোপ এর বেশির ভাগ দেশই অর্থনৈতিক রুগ্নতায় পড়ে যাবে। অর্থনৈতিক দূরবলতার কারনে তারাও পোষাক খাতে বাজেট কমিয়ে দিবে যার প্রভাব পড়বে আমাদের উপর। ইতোমধ্যে বিজেএমইএ এর সভাপতি রুবানা হক এর ভিডিও বার্তা থেকে এটা প্রতিয়মান যে আমদের অনেক শিপমেন্ট বাতিল হয়েছে। অনেক বায়ার পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এখন প্রস্তুত পন্য নিতে অনিহা যানাচ্ছে। তাই বলা যায় আমাদের এই শিল্প বিরাট ধাক্কা খেতে যাচ্ছে। অতীতে আমাদের বিশ্বমন্দা ছুতে পারে নি যার মূল কারন ছিলো রেমিট্যান্স। যেসব দেশ থেকে অমরা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাই যেমন সৌদি আরব সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ,আমেরিকা সহ বিশিরভাগ দেশই লকড ডাউন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে ঐসব দেশ থেকে ফিরে আসতে পারে হাজারো শ্রমিক। তাছাড়া তেল নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যে তেলের মূল্যে ভাটার কারনে দেশীয় খরচ কমিয়ে আনবে যার কারনে কর্মীফেরৎ হতে পারে। আর এই কর্মী ছাটাই বা ফেরৎ আমাদের মন্দাকে দ্বিগুন গতি এনে দিবে। সরকার ইতেমধ্যে ব্যাংক থেকে লক্ষ্যমাত্রা পরিমান ঋন নিয়ে নিয়েছে। বিশ্ব মন্দা বা দেশিয় মন্দার ফলে সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। দর হারাবে ভোগ্য পন্য, কৃষক হবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা যেহেতু কৃষিনির্ভর দেশ তাই এর প্রভাব হয়তো না দেখে অনুমান করতে পারবো না। আরএমজি রপ্তানীতে ভাটা পড়ার কারনে এই শিল্পে কর্মীচাটাই সহ প্রাইভেট সেক্টরে বিরাট ধাক্কা আসবে যার প্রভাব পড়বে সাধারন জনগণের উপর। তবে এটা নিশ্চিত আমাদের খাবারের অভাব হবে না। অন্তত না খেয়ে থাকা লাগবে না । ধান চাল যথেষ্ট মজুদ আছে। তবে বিশাল পরিমাণ মানুষ বেকার থাকলে ক্রয় ক্ষমতা কমে আসবে এবং এর প্রভাব পড়বে কৃষক তথা অর্থনীতির উপর। তবে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে ঔষদ রপ্তানী বাংলাদেশের জন্য আশার বানী। এই খাতে বাড়তে পারে রপ্তানী ও বৈদেশিক আয়। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে শিল্পায়নের চেয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ বাজেট ছিলো। শিল্পায়নে বাজেট কম থাকায় কর্মসংস্থান বাড়েনি, বেড়েছে বেকারত্ব। জিওগ্রাফিক্যাল ডিভিডেন্ড এর এই যুগে এসে বিশাল কর্মক্ষম লোক বেকার থাকা এমনিতেই আমাদের জন্য বড় হুমকি৷ তার উপর করোনা প্রভাব যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। করোনার প্রভাবে শিল্প উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে বিশাল ধাক্কা আসবে আর সেটা কাটিয়ে উঠার রাস্তা এখনো অজানা। সময় ঠিক করে দিবে করনীয়৷ তবে সঙ্কার বিষয় এই যে, অাগামীতে অামাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
BBS cable ad

সম্পাদকীয় এর আরও খবর: