করোনার মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পরিশোধ

মহামারি করোনার বছর হিসেবে সারা বিশ্বে আলোচিত হয়ে রইল ২০২০ সাল। করোনা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এ বছরই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছেন প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার। বিদেশি ঋণ পরিশোধ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
অপরদিকে করোনার বিপর্যস্ততা কাটিয়ে উঠতে একের পর এক সুবিধা নিচ্ছেন সব ধরনের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়ের কারণে গত বছর দেশীয় ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করেননি ৩৬ হাজার কোটি টাকার সুদ। যদিও সব খাতের ব্যবসায়ীরা করোনায় সমহারে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও নিরাপত্তা সামগ্রী খাতের ব্যবসায় উল্লম্ফন হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিদেশি ঋণের বিপরীতে ব্যবসায়ীরা ১৬১ কোটি ৯০ লাখ ডলার পরিশোধ করেছেন, স্থানীয় মুদ্রায় যা ১৩ হাজার ৭৬২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূলধন বা মূল ঋণ পরিশোধ করেছেন ১৪৬ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা ১২ হাজার ৪৩৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সুদ বাবদ ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলার বা এক হাজার ৩২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ব্যবসায়ীরা সুদ বাবদ পরিশোধ করেছেন ১৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করেছিলেন ৯ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর’২০) ৪৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পরিশোধ করেছেন, স্থানীয় মুদ্রায় যা তিন হাজার ৮৭৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের দুয়ার উম্মুক্ত হয় বছর পাঁচেক আগে। এর পর থেকেই ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন এদিকে। দেশীয় ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হলেও নির্দিষ্ট সময়ে তারা ঠিকই পরিশোধ করছেন বিদেশি ঋণের অর্থ।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিদেশি ঋণ অনুমোদিত হয়েছে বেসরকারি খাতে এক হাজার ৩১৩ কোটি ২৭ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় এক লাখ ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এসব ঋণের বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদি বলে জানা গেছে। ঋণের বড় গ্রহীতা হচ্ছেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতিতে বিদেশি ঋণ কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। ‘প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব শর্ট টার্ম ফরেন কারেন্সি ফিন্যান্সিং অব ব্যাংকস’-এর ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান এ ঋণ বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ঋণের এ লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দিনে দিনে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে এ ধরনের ঋণের দ্বারা অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মানসুর বলেন, ‘বিদেশি ঋণের কোনো গ্রহীতা একবার খেলাপি হলে আর ঋণ পাবে না দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বিদেশি ঋণ থাকা অবস্থায় অন্য প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নেয়া সহজ নয় কোনো প্রতিষ্ঠানের। বিদেশিপ্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেয়ার সময়ে গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, ক্রেডিট রেটিং ও গ্রহণযোগ্য নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে কি না, তাও যাচাই করে দেখে। তারা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি ডিসিপ্লিন দেখে। ঋণ বিতরণ ও আদায়ের একটি সংস্কৃতি তারা গড়ে তুলেছে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও জরিমানা এড়াতে বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধে সবসময়ই সজাগ থাকেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।’
জানা গেছে, বাংলাদেশে ঋণ সুদহার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বছর পাঁচেক আগে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম দিকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিলেও এখন সব খাতের উদ্যোক্তারাই নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বিদেশি সংস্থার পাশাপাশি দেশীয় ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকেও ঋণ নিচ্ছেন, যা বিদেশি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি ঋণ সবার জন্য উম্মুক্ত করা উচিত নয়। দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতাদের বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়া সংকুচিত করা উচিত। দেশীয় ক্ষেত্রে খেলাপি হয়ে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়ার সময় হয়েছে। নইলে এক দেশে দুই ধরনের ঋণ সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক ব্যাংক খাতে।