মরুভূমির সাম্মাম ফলের সমাহার
এম.মিরাজ হোসাইন, বরিশাল
‘করোনা আমার জন্য আশির্বাদ, আমার ভাগ্য খুলে দিয়েছে’- বৈশ্বিক মহামরি করোনা নিয়ে এমন ইতিবাচক কথাগুলো বললেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেরার আন্ধারমানিক ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক হাসান মাহমুদ সাইদ (৪৫)।
টানা দেড়বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে তিনি করোনা আতংকে ঘরবন্দী থাকননি। কৈশোর বয়সে নিজ হাতে গড়া খামারে দুরদেশের মরুভূমির সাম্মাম, তরমুজ-বাংঙ্গি (ফুট) জাতীয় নানান সু-স্বাদু ফলের আবাদ করেছেন। নদীরদেশ মেহেন্দিগঞ্জের প্রত্যন্ত জনপদ আন্ধারমানিক ইউনিয়নে তিনি মরুভুমির দেশের ফলের সমাহার ঘটিয়েছেন। এতে শুধু তার ভাগ্যই ফেরেনি, আন্ধারমানিক ইউনিয়নে বেকার তরুনদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসান মাহমুদ সাইদের খামারে সারি সারি মাচায় ঝুলছে সৌদি আরবের স্বুস্বাদু ফল তিন জাতের সাম্মাম ফল যথাক্রমে রিয়া, রকমেলান ও অ্যারোশ সুইট। যা দেখতে এদেশের বাংঙ্গি জাতের ফলের মতো। এছাড়া দেশের তরমুজের মতো মরুভূমির ফল বেঙ্গল টাইগার, সুইট ব্লাক ও কাণিয়া ফলেছে তার খামারে। এগুলোর বাহ্যিক রূপ দেশী ফলের মতো হলেও স্বাদে আছে ভিন্নতা।
সাইদ হাসান গতবছর ২৪ শতাংস জমিতে মরুভূমির ফল আবাদ করে বিক্রিতে আড়াইলাখ টাকা লাভ করেছেন। এবছর ১ একর জমিতে আবাদ করে ১০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি। বীজ বপনের ১৫ দিনের মধ্যে ফুল ধরে এবং ৩ মাসের মধ্যে বিক্রয়যোগ্য এ ফলগুলো ১২ মাসই আবাদ করা যায়।
এছাড়াও তার খামারে আবাদ করা হয়েছে- বিদেশী জাতের ব্রোকলি (ফুলকপি), মিষ্টি মরিচ, লেটুস পাতা, রেডবিট (শালগম জাতীয়), টমেটো, আলুবোকরা, লবঙ্গ, ডুবিয়ান (মালয়েশিয়ান ফল) সাদা জাম, কমলাসহ দুপ্রাপ্য বিভিন্ন জাতের বিদেশী ফলের চারা। ৫টি মাছের ঘেরে আছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
মেঘনাবেষ্টি উপজেলা মেহেন্দিগঞ্জের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম নদী-খাল দিয়ে বিচ্ছিন। মেঘনা ও কালাবদরের সংযোগ স্থাপনকরা নদীটির তীরের গ্রামটির নাম আজিমপুর। খর¯্রােতা নদীটি স্থানীয়ভাবে ‘লতা নদী’ নামে পরিচিত। গ্রামের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। নদীর তীরে ৫ একর জমিতে ২০১০ সালে কৃষি ও মাছের খামার স্থাপন করে হাসান মাহমুদ সাইদ। দৃষ্টিনন্দন খামারটি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন প্রতিদিন। আন্ধারমানিক ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুন সরদার খামারটি এলাকার কৃষি ও মৎস্যচাষের জন্য রোল মডেল বলে মন্তব্য করেন।
উদ্যেক্তা হাসান মাহমুদ বলেন, নবম শ্রেণীর ছাত্রবস্থায় তিনি নিজ বাড়ির পুকুরে মাছ চাষ করেন। ৯০ সালে এসএসসি পাশের পর কৃষি ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋন নিয়ে করেন মাছের ঘের। এরপরে শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলার গল্প। এরইমধ্যে খামারের পরিধি বৃদ্ধি পায় ৫ একরে। ২০১০ সালে ৫টি ঘেরের চারপাশে কৃষিকাজ শুরু করেন। খামার সম্প্রসারনের পাশাপাাশি সম্পন্ন করেন দর্শনে ¯œাতোত্তর ডিগ্রী অর্জন এবং ‘৯৬ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে যোগ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে এখন প্রধান শিক্ষক।
খামারে সব সময় নতুন কিছু সৃষ্টির নেশা- এমনটা জানিয়ে হাসান মাহমুদ সাইদ বলেন, গতবছর বরিশাল নগরীর একটি বীজ বিক্রির দোকানে পরিচয় হয় থাইল্যান্ডের চিয়াত তাই কোম্পানীর (বীজ বাজারজাতাকারী প্রতিষ্ঠান) এক বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে। তার পরমর্শ ও বিনামূল্যে দেয়া বীজে আরব দেশের স্বুস্বাদু ফল আবাদে আকৃষ্ট হন।
আজিমপুর গ্রামের আরেক স্কুল শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, সহকর্মী হাসান মাহমুদের কৃষি ও মাছ চাষে লাভ দেখে তিনিও নিজ বাড়িতে আধা একর জমিতে খামার করেছেন। জাকির হোসেন বলেন, ‘চাকরীর আয়ে চেয়ে মাছ চাষ ও কৃষি কাজে আয় অনেক বেশী। শিক্ষিত তরুনরা চাকুরীর আশায় না থেকে এ কাজ তারা যেমন আত্মনির্ভরশীল হবে, দেশও সমৃদ্ধ হবে’।
আন্ধারমানিক ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুন সরদার বলেন, হাসান মাহমুদের খামারে কৃষি অধিদপ্তরের উদ্যেগে বিভিন্ন প্রকার ফল ও আখ এবং নানা প্রকার সবজির প্রদর্শনী আবাদ করা হচ্ছে। আগ্রহী তরুনদের সেখানে নিয়ে প্রশিক্ষন কর্মশালা করা হয়। এরই মধ্যে আন্ধারমানিক ইউনিয়নের দুই যুবক প্রশিক্ষন নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে খামার গড়েছেন।
তাদের একজন সুলতান মো. নিপু মোল্লা বলেন, ‘সাইদ স্যার আমাদের পথপ্রদর্শক’। তিনি বলেন, তিনি এক কানি (৮০ শতাংশ) জমিতে এবার শীতকালিন সবজির পাশাপাশি সৌদির ফল আবাদ করেছেন। শীতের পরে শুধু সৌদির ফলই আবাদ করবেন তিনি।
আন্ধারমানিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক হাসান মাহমুদ সাইদ এলাকাতে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার দেখাদেখি আরও অনেক শিক্ষিত তরুনরা এ পেশার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এটা দেশের বেকারত্ব লাঘবে অনুকরনীয় একটা দৃষ্টান্ত।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, অধিদপ্তরের বিভাগীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসান মাহমুদের খামার পরিদর্শন করেছেন। তার উদ্যেগ সকল মহলে প্রসংশিত।