ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লবণ পানিতে বিবর্ণ সাতক্ষীরা উপকূলের সবুজ প্রকৃতি
এমএ জামান, সাতক্ষীরা:
২০২০ সালের ২০মে প্রকৃতির সবুজ দেয়ালে আঘাত হেনেছিল সুপার সাইক্লোন আম্পান। সেই আঘাতের ক্ষত আজও দগদগে। আম্পানের ক্ষত শুকানোর আগেই ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে আরেক সুপার সাইক্লোন ইয়াস। এর আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে উপকূলে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার ধকল সামলে উঠার আগেই আঘাত হানে আম্পান। এরমধ্যে ফনি, মহাসেন, নার্গিস, বুলবুল আঘাত হানলেও খুব বেশি ক্ষয়-ক্ষতি করতে পারেনি।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিবছর ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়। একটি ঝড়ের ক্ষত শুকানোর আগেই আঘাত করে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। এখানে ঝড়ে যত ক্ষতি হয় বাঁধ ভেঙে হয় তার শতগুন। ঝড়ের যত রাগ যেনো বাঁধের উপর। বাঁধ ভাঙে আর প্ল¬াবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে যায় মাছের ঘের, পুকুর, ফসলের ক্ষেত, ঘর-বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে নি:স্ব হয়ে যায় হাজার হাজার পরিবার। প্রতিবছর উদ্বাস্তু হয় ৩০-৩৫ হাজার পরিবার। এভাবেই উপকূলবাসির দু:খের কথা বলছিলেন সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো: আনিসুর রহিম।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্পান ও ইয়াস প্রবল শক্তি নিয়ে বিষাক্ত নখের ডানা ঝাপটেছিল উপকূলে। ঝড়ের ঝাপটায় পাখির পালক ছেড়ার মতো ছিড়েছিল সবুজ গাছপালা, ঘরবাড়ি আর বিদ্যুতের খুঁটি। ভেঙেছিল উপকূলীয় বাঁধ। ভেসেছিল শতশত ঘরবাড়ি, মাছের ঘের, পুকুর আর ফসলের ক্ষেত। ঢেউয়ের টানে উপড়ে পড়েছিল অসংখ্য গাছ। ডুবেছিল রাস্তা। বাড়ির উঠোনে উঠেছিল জোয়ারের নোনা পানি। সেই নোনা পানির প্রভাব পড়তে শুরু করে উপকূলীয় অঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ। শুধু সুন্দরবনের গাছ নয়, সামাজিক বনের সবুজ দেয়ালেও ঝড়ের দগদগে ক্ষত সৃষ্টি হয়। যা আজও শুকায়নি।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আশাশুনি সদর, আনুলিয়া, খাজরা, বড়দল, কাদাকাটি, কুল্যাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের সবুজ গাছপালা মরে বিবর্ণ হয়ে গেছে। গোটা প্রতাপনগরে দেখা যায় বিবর্ণ প্রকৃতি।
সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়ক, সদরের বৈকারি সড়ক, তালার ইসলামকাটি সড়ক, আশাশুনি দরগাহপুর সড়কসহ বিভিন্ন সড়কের গাছ মরে সাদা হয়ে গেছে। শুকিয়ে যাওয়া গাছের ডালপালা সড়কে চলাচলকারী মানুষকে জীবনের চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
নাগরিক নেতা অধ্যাপক আনিসুর রহিম আরও বলেন, আম্পানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাগরপাড়ে সুন্দরবনের কোলে আশাশুনি সদর, প্রতাপনগর, আনুলিয়া, শ্রীউলা এবং শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী ও কাশিমাড়ি ইউনিয়ন। পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদ আর পূর্বে খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত এসব ইউনিয়ন সবুজে সবুজময়। ছোট ছোট গ্রামগুলো ছবির মতো দেখতে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় এসব গ্রামে প্রতিবছর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ের আঘাতে ইউনিয়নগুলো একেকটি ধ্বংসস্তুপ। বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত। নোনা পানির প্রভাবে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। অনেক গাছ মরতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় চলা ঝড়ো বাতাসে ভেঙে যাওয়া গাছগুলোর এমন দশা হয়েছে। একারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সুন্দরবনাঞ্চল সংলগ্ন পরিবারগুলো। যেসব গাছ পানি সহ্য করতে পারেনা সেসব গাছ মরে গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সবুজ গাছে ঘেরা ঠিক যেন ছবির মতো সাজানো গোছানো ছিল প্রতাপনগর ইউনিয়ন, আনুলিয়া ইউনিয়ন, শ্রীউলা ইউনিয়নসহ আশাশুনির ১১টি ইউনিয়ন। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন যেন সবুজ গাছে ঘেরা প্রকৃতির দেয়াল। ঝড়ের আঘাতে প্রকৃতির সেই সবুজ দেয়াল এখন বিবর্ণ রূপ নিয়েছে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে চলা ঝড়ো বাতাস ও সামুদ্রিক লবণ পানির স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে গাছের শ্বাসমূল শোষণ করায় গাছগুলো মরে যাচ্ছে। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রের প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনাঞ্চল। বিশেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাত থেকে এই বন উপকূলকে রক্ষা করেছে। সেই দুর্যোগে বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হয়েছিল বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। বনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বন্যপ্রাণির ক্ষতি হয়েছে অনেক। এক প্রশ্নের জবাববে তিনি আরও বলেন, যেসব গাছ মরে যাচ্ছে সেসব গাছের লবণ সহিষ্ণু ক্ষমতা ৫ থেকে ১০ পিপিটি। সাধারণত বর্ষাকালে ওই এলাকায় ১০পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা দেখা যায়। বর্ষাকাল এসে গেছে অথচ লবণাক্তার মাত্রা এখন ১৮ পিপিটি। তিনি বলেন, সাধারণত লবণাক্ততা ১৫পিপিটি মাত্রার ঊর্ধে গেলে গাছ মারা যায়। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় টেকসই বাঁধ।
অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, এলাকা রক্ষায় দেয়াল হিসেবে কাজ করেছে বনাঞ্চল, ম্যানগ্রোভ বন ও সবুজ বেষ্টনী। এখন সেই বন নেই। সেই গাছপালা নেই। নেই সেই সবুজের সমারোহ। লবণাক্ততার প্রভাবে দিনদিন এখানখার পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকির মধ্যে পড়ছে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আ ন ম গাউছার রেজা বলেন, ঝড়ো বাতাস সমুদ্র ঘেষা গাছগুলো যেন মুড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, নারগিস, মোহাসেনসহ বড় বড় ঝড়কে মোকাবেলা করেছে বনাঞ্চল। বনাঞ্চল ছিলো বলেই উপকূলের হাজার হাজার পরিবার রক্ষা পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় সাধারণত লবণাক্ততা সহিষ্ণু গাছপালা জন্মে। তবে সব গাছ সমান লবণাক্ত সহিষ্ণু নয়। ঝড়ে এসব গাছ মরে না। ঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে প্ল¬াবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্ল¬াবনের পানি জমে থাকার কারণে অতিরিক্ত লবণাক্ততা দেখা দেয়। এতে গাছপালা মারা যায়। সুন্দরবনের সব গাছও সমান লবণাক্ততা সহিষ্ণু নয়। মাত্রারিক্ত লবণাক্ততার কারণেও মারা যায় সুন্দরী গাছ। এ অবস্থা চলমান থাকলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে পরিবেশের উপর। তাই টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল একদিন পরিবেশ বিপর্যয়েরর শিকার হয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের মাছ ধরা জেলে আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, আইলার পর গত ৫/৬ বছর ধরে এ অঞ্চলের গাছপালা বিলীন হতে চলেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আম্পানের ঝড়ো হাওয়ায়। নদী সংলগ্ন বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উপড়ে গেছে। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে এখনো ভাসছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলে নদী রক্ষা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে লিডার্স নামক একটি বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, বন ও বনের গাছ পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে যেভাবে বন ও সবুজ বেষ্টনী ধ্বংস হচ্ছে, এর ফলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। সাগরের নোনা জলের প্রভাবে কৃষিতে প্রভাব পড়ছে। গ্রামগুলো পানিতে ডুবে থাকায় আবর্জনা পচে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সুপেয় পানির অভাব প্রকট। লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতা গাছ মরে যাওয়ার কারণ বলে মনে করেন এই পরিবেশবিদ।
p