বাণিজ্য আলোচনায় বড় বাধা সীমিত রফতানি পণ্য

বাংলাদেশের রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য নেই। সীমিত পণ্যের ওপর নির্ভর করে দেশের রফতানি বাজার, যা বাণিজ্য আলোচনায় বড় বাধা বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ‘রিফ্লেকশনস অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড: বিল্ডিং ন্যাশনাল ক্যাপাবিলিটিস ইন ট্রেড নেগোসিয়েশনস’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। সহযোগিতায় ছিল ইউকে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্যের অভাব বাণিজ্য আলোচনার জন্য অন্যতম বড় সমস্যা। আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য খুব সীমিত। এছাড়া পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা বা কাঁচামালও নেই। বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানি করে সামান্য মূল্য সংযোজন করে আমরা তা বিক্রি করি।’ এজন্য রুলস অব অরিজিন বা উৎপত্তি সম্পর্কিত নিয়মগুলো বাণিজ্য আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পর অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন—আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ কোনটি? আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা আরো ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু কী চাই ও কীভাবে চাই—এটি পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করতে হবে।’
ভবিষ্যতের বাণিজ্য আলোচনা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ—উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘খাদ্য ও জ্বালানি—এ দুটি মৌলিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আমরা ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করি। তাই যেকোনো আলোচনার সময় এ মৌলিক বিষয়গুলো ঘিরেই কৌশল তৈরি করতে হয়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছি, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। এর একটি বড় কারণ অভ্যন্তরীণ আলোচনা পদ্ধতি। প্রতিনিধিরা চাহিদার তালিকা পাঠায়, তারপর কর্মকর্তারা শিল্প মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। এর জবাব পেতে কখনো কখনো মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। ছয় মাস পর উত্তর আসে। তখন দেখা যায় সবাই সবকিছু ভুলে গেছে। এটা হওয়া উচিত নয়।’
প্রমাণভিত্তিক আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কথা শুনে মনে হয়েছে আমরা অপরিপক্ব। আপনি একটি পেশায় আছেন, সাধারণের মতো কথা বলা ঠিক নয়। তথ্য নিয়ে আলোচনা, ডাটা যাচাই, প্রমাণ ও পরীক্ষা করে এটি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে এ সংস্কৃতি নেই।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি বাণিজ্য। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ও দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। তবে বর্তমানে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা চাপের মুখে রয়েছে। সুরক্ষাবাদ বাড়ছে, সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে যেতে দেখেছি। বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিগুলোও পুনর্বিবেচিত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। বৈশ্বিক বাজারে আরো কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। তাই বাণিজ্য শুল্কের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করতে হবে। বিশ্বজুড়ে অংশীদারদের সঙ্গে বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’
সারাহ কুক আরো বলেন, ‘বাণিজ্যনীতি জটিল ও আলোচনা কঠিন। এটি রাজনৈতিক ও টেকনিক্যাল। বাংলাদেশকে সফল হতে হলে তীক্ষ্ণ মেধা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও একটি সুস্পষ্ট কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। নিজেদের স্বার্থ কী ও বাণিজ্য অংশীদারদের স্বার্থ কী তা অবশ্যই বুঝতে হবে। একটি দেশ যখন বাণিজ্য শাসন ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে, তখন দেশের অভ্যন্তরে কেউ লাভবান হয় আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়—যদিও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিই লাভবান হয়।’ তাই বাণিজ্যনীতি সঠিকভাবে তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন তিনি।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘একটি ভালো বাণিজ্য চুক্তি ও একটি উৎকৃষ্ট চুক্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ভর করে আলোচনার টেবিলে বসা মানুষদের দক্ষতা এবং বাইরে থেকে যারা সহায়তা করেন তাদের সক্ষমতার ওপর। আইনি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বোঝা, ভিন্ন খাতের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ, নিজের শক্তি ও দুর্বলতা জানা—এসবই অপরিহার্য। বাংলাদেশে মেধাবী মানুষ রয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, ক্ষমতায়িত করা ও ধরে রাখা।’
সভাপতির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্য আলোচনা সহজ বিষয় নয়। এটি কেবল শুল্ক বা বাণিজ্য সম্পর্কিত নয়; এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। এতে বাণিজ্য নীতি সম্পর্কিত স্বচ্ছতা এবং স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শ্রম বিষয়ক সমস্যাসহ আরো বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হয়। এ কাজে অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন।’
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খান, ইউএনডিপি বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, কান্ট্রি ইকোনমিক অ্যাডভাইজার ওয়েইস প্যারে, র্যাপিড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।