শিরোনাম

South east bank ad

‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০২০, প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া জানালেন মাসরুর আরেফিন

 প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সাহিত্য

‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০২০‘ পেয়ে ভাল লাগছে। আরও খুশি লাগছে প্রকাশের পরপরই বিশ্রী এক ফালতু বিতর্কে জড়িয়ে পড়া এই উপন্যাসটার জন্য। এটা মোটামুটি ভাল একটা অন্যরকম উপন্যাস যা দুবার পড়া যায় (দ্বিতীয়বার পড়ছেন আমার বন্ধু চিত্রশিল্পী নাজিব তারেক; কথা সত্য)।
‘ঢাকা ট্রিবিউন’ পত্রিকার অনলাইন খবর মারফত জানলাম বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন তিন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক—ওয়াসি আহমেদ, মামুন হুসাইন এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল; আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর বেগম আখতার কামাল ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সরিফা সালোয়া ডিনা। এই তালিকার তিন কথাশিল্পীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ‘প্রথমা প্রকাশন‘-কে যারা সাহস নিয়ে এই বিশাল উপন্যাসটা ছাপিয়েছিল। বিশেষ করে ধন্যবাদ প্রথম আলো সম্পাদক মতি ভাইকে, বইটার সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা জনাব অরুণ বসুকে, প্রথমা-র তখনকার ব্যবস্থাপক কবি জাফর আহমেদ রাশেদকে, আর সেই শাহবাগ যুগ থেকে আমার কাছের মানুষ কবি সাজ্জাদ শরিফকে যার সঙ্গে দুই মিটিংয়ে বসে ঠিকঠাক করা হয়েছিল এই দীর্ঘ উপন্যাসের সেনসিটিভ কিছু জায়গা।
ধন্যবাদ এ উপন্যাসের প্রথম দু পাঠক কবি মারুফ রায়হান ও কবি ব্রাত্য রাইসুকে। ব্রাত্য রাইসুর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ মেনে নিয়ে উপন্যাসের শেষ দিকে ৬-৭টা নতুন পৃষ্ঠা যোগ করেছিলাম, মনে আছে।
জেমকন গ্রুপকেও ধন্যবাদ তারা শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণার ব্যাপারে মহাকৃপণ এই দেশে এখনও অর্থমূল্যে তুলনামূলক বড় এই পুরস্কারটা চালু রেখেছেন বলে। আজ দেখলাম আগে এই পুরস্কার পাওয়া লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, সেলিম আল দীন, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, এসব গুরুত্বপূর্ণ নাম। নিজেকে লেখক বলেই মনে হচ্ছে তাহলে, বেশ!
খুব মিস করছি ‘আগস্ট আবছায়া‘ বইটার রক্ত-হিম-করা প্রচ্ছদের স্রষ্টা প্রিয় শিল্পী সেলিম আহমেদকে। মাত্র দু‘ দিন আগে আমি তাঁর আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে লিখেছি এই ফেসবুকে। ‘আগস্ট আবছায়া‘-র ভালই এক পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে গত দু‘ বছরে। তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আর তাদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে মৃত্যু নিয়ে এত কাজ, এত গবেষণা দেখে। সেলিম ভাইয়ের জানাজায় কবি মাহবুব আজীজ তো বলেই বসলেন: ‘উপন্যাসটা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলতে গিয়ে বেসিক্যালি মৃত্যু নিয়ে লেখা দীর্ঘ এক গাথা। সহিংসতা কিম্বা স্মৃতি কিম্বা সময় নিয়ে কাজ—এসব পরের কথা।’
প্রচ্ছদে আঁকা সেলিম আহমেদের দুই নির্বিকার মহিষ উপন্যাসের অন্যতম সেই মূল থিমকে—জীবনের মৃত্যুময়তাকে—আবছায়া মতো লেপটে-ধেবড়ে-জেবড়ে যাওয়া সেন্টার পয়েন্টটার নিচে বাঁয়ে এমনভাবে মূর্ত করেছিল যে প্রচ্ছদটা দেখলেই আজও আমার মৃত্যুভয় হয়।
পুরস্কার পাওয়ার এই দিনে আমি দুঃখিত যে আমার শুধু সেলিম ভাইকেই মনে পড়ছে। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের কোন্ এক ছোট নিঃসঙ্গ জায়গায় কেমন এক মর্মঘাতী ঘোর অন্ধকারে এ-মুহূর্তে শুয়ে আছেন তিনি, আর বাইরে পৃথিবীতে তাঁর প্রিয় মাসরুর আরেফিন কিনা উচ্ছ্বাস করছে পুরস্কারের আলোয়। নাহ!
এ বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর ১২৫ থেকে অকালপ্রয়াত শিল্পী সেলিম আহমেদের স্মৃতির উদ্দেশে আজ এই মন খচখচ দিনে নিচের এ অংশটুকু:
"আমি ভয়বিহ্বল তাকিয়ে আছি ওই বর্ণনা-অযোগ্য হলুদ আলোর খেলার দিকে, আর হঠাৎই বুঝলাম এটা ভূমিকামাত্র, যেই না সেই আলোর প্যাঁচানো-ঘোরানো ধোঁয়ার মতো দেখতে মেঘ থেকে দুদ্দাড় করে কাঁধ বাঁকিয়ে সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে লাগল অসংখ্য মহিষ—তাদের পুরো শরীর না, শুধু মুখগুলো দৃশ্যমান করে।…ওদের মুখে গেজানো ফেনা, ফেনার রং চুনের মতো, জিংক অক্সাইড, ওদের নাকের ফুটোগুলো আস্ফালনে ভরা আর চোখ লজ্জাহীন বেয়াড়ার—গর্বোদ্ধত মদমত্ত মহিষের দল।…গণনার-অযোগ্য সংখ্যক মহিষ, ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনের লেক ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে সোজা তাকালে যতটা দিগন্ত দেখা যায়, তার বাম থেকে ডান পুরোটা জুড়ে আকাশে মহিষ আর মহিষ—সংখ্যাতীত, তাল তাল।
সব কটা মহিষেরই একইরকম শিং নিচের দিকে নামানো, দীর্ঘায়তন মুখ, মোটা মোটা চার পা গাবদা গাবদা, শিং পেছনের দিকে বাঁকানো, পেট বড়, শরীর ছোট, কপাল সমতল, চোখ প্রবল কিন্তু ভাবলেশহীন, শিং নিচে নেমে পেছনে গিয়ে ফের অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ওপরের দিকে উঠেছে, চোয়াল চওড়া, ঘাড় লম্বা, শিং কপালের সমতলে, আর তাদের চেহারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক তাদের অন্যমনস্কতা—এক আনমনা উদাসীন ভাব, যদিও তাদের ফেনা গেজিয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে ওরা আসলে কমবেশি—তবে সনাতন ও বৈচিত্র্যহীন ভঙ্গিমায়—প্রাণ হন্তারক, ন্যূনতম অর্থে বিনাশক প্রকৃতির।
আমি ভাবলাম, ঢাকা শহরের আকাশে কী করছে ওরা? একটার মুখ থেকে বোধ হয় কেমন গঁঅঅঅ শব্দ উঠল। ঠিক কোন্ মহিষটা শব্দ করল, তা বোঝার আমার উপায় নেই কোনো—কিন্তু ওই ডাক আমার চেনা, এশিয়ান ওয়াটার বাফেলোর চিরপরিচিত গড়গড় করে মার্বেলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা গ ডাক। কিছুক্ষণ, মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরই আকাশ আবার আগের মতো সুস্থির, গরমে কাঁপা, মৌলিক।"

(মাসরুর আরেফিন এর ফেসবুকওয়াল থেকে নেয়া)

BBS cable ad

সাহিত্য এর আরও খবর: