শিরোনাম

South east bank ad

স্বেচ্ছাসেবকরাই বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু

 প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারী ২০১৮, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

ড. মোহাম্মদ এয়াকুব* খুব বেশীদিন নয় ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় অগ্নিকান্ডে আমরা প্রায় ১১৩৪ লোককে হারিয়েছি। আরো অনেকের প্রাণহানি ঘটতো যদি সেদিন স্বেচ্ছাসেবকরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে না আসতো। উদ্ধারের জন্য নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মীবাহিনীর তুলনায় স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল অনেকবেশী তৎপর। কিসের টানে তারা সেদিন অদম্য ছিল? কোন ঝুঁকিই তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারন একটাই তা হচ্ছে মানবতা। তাদের মধ্যে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এত বেশী যে তারা নীরব দর্শক হয়ে ছিল না অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে, আহত মানুষদের কষ্ট লাঘব করেছে, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মানুষের সবচাইতে বড় পরিচয়, তা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে মানুষের যে স্বতস্ফুর্ততা এবং একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বেচ্ছাশ্রমের অন্যতম দৃষ্টান্ত। আমরা দেখি অগ্নিকান্ড, পুকুরের পানিতে এবং ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে যাওয়া, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, গাড়ি ও ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদ রক্ষায় সাধারণ মানুষরা এগিয়ে আসে। এই কিছুদিন আগে ঢাকায় এক শিশুকে ওয়াসার ম্যানহোল থেকে তুলে এনেছেন একজন ব্যক্তি। এরা কারো নিয়োজিতে স্বেচ্ছাসেবক নয়। তারা নিজ তাগিদেই এগিয়ে আসে, এমনকি নিজেকে সেবক হিসাবেও দাবী করে না। তাদের সবচাইতে বড় পরিচয় স্বেচ্ছাই মানুষের সহযোগিতায় সদা তৎপর। কারো কাছে বিনিময় চায় না, মানুষ প্রশংসা করবে অনেকে হয়তো তা ও আশা করে না। স্বেচ্ছাসেবকরা বিনিময় না চাইলেও অন্যদের উচিত তাদের ত্যাগস্বীকারকে শ্রদ্ধা করা। স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা। এরকম যেন না হয় যে যিনি সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন তিনি ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছেন। অবশ্য উপকার করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন তার উদাহরণ বাংলাদেশে প্রচুর। অকৃতজ্ঞ মানুষদের কারনেই এটা ঘটে। আমরা এক সময় দেখতাম প্রায় প্রতিটি পাড়ায় কয়েকজন মানুষের উদ্যোগে ক্লাব গড়ে উঠতো। সে সকল প্রতিষ্ঠান খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। এলাকার সামাজিক অনুষ্ঠান, পরিচ্ছন্নতা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মানুষের বিপদ আপদে তারা এগিয়ে আসতো। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার পর ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছে যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্কাউটস, গার্লসগাইড, এবং বিএনসিসি। আবার শহর কেন্দ্রিক লায়নস, রেড ক্রিসেন্ট, রেডক্রস সহ আরো অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যারা বাংলাদেশের যে কোন দুর্দিনে এগিয়ে আসে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখে। এছাড়াও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে অলাভজনক ও অরাজনৈতিক কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে উঠে যা এনজিও হিসাবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা যারা তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দিক নির্দেশনা এবং নীতি নির্ধারনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাবে যারা সরাসরি কার্যক্রম বাস্তবায়নের সাথে জড়িত বিশেষ করে সংস্থার প্রধান নির্বাহী এবং কর্মীগন আর্থিক প্রাপ্তির ভিত্তিতে সেবাদান কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকে। চাকুরী হলেও কর্মীদের মধ্যে মহতি উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ততার অনুভূতি কাজ করে। আমরা এনজেলা গোমেজের কথা জানি যিনি বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজের উন্নয়নে একজন পথিকৃত। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতার পর ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে ৪৬ বছর ধরে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে এদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে এসেছে বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যাভ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানী, পরিবেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন, অধিকার সহ আরো অনেক বিষয়ে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গনসচেতনতা এবং কাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সকল প্রতিষ্ঠানেরই ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং কর্মপরিধির সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে তবে এনজিও সহ বাংলাদেশের সকল স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এদেশের অগ্রযাত্রায় বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং হালে সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের অংশীদার হিসাবে কাজ করছে। তবে সাম্প্রতিককালে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব, এনজিও, পাড়াভিত্তিক পাঠাগার, সাংস্কৃতিক দল, স্কুলগুলোতে স্কাউটিং সহ আরো মহতি উদ্যোগ কমে যেতে শুরু করেছে। এর অনেক কারন থাকতে পারে। তবে একটা কারন আমরা অনুমান করতে পারি তা হচ্ছে বানিজ্যিকীকরণের ব্যাপক প্রসার। বিশ্বায়নের যুগে আমরা হয়তো তা রোধ করতে পারবো না। তবে আমরা প্রত্যাশা করি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একেবারে হারিয়ে না যায়। কারন এর সাথে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার সম্পর্ক। প্রতিষ্ঠানসমূহ টিকিয়ে রাখতে হলে সরকার ও সুশীল সমাজের করণীয় কি সে সম্পর্কে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন। আজ ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস। এদিনে আমরা তাদেরকে স্মরণ করি যারা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে মানব উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে আত্নত্যাগ করেছেন, নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবশেষে শ্রদ্ধা জানাই তাদেরকে যারা মানুষের কল্যাণে এখনও নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। *লেখক: উন্নয়ন গবেষক
BBS cable ad

সম্পাদকীয় এর আরও খবর: