কমেছে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা প্রভাব পড়বে কোরবানিতে

চট্টগ্রামের জাকির হোসেন ও তার চার ভাই মিলে গতবার দুই-আড়াই মণ ওজনের একটি গরু ভাগে কোরবানি দিয়েছিলেন। তবে এবার জাকিরের তিন ভাই পারলেও জাকির ও তার আরেক ভাই কোরবানি দিতে পারছেন না। তাই অন্য ভাইয়েরা বাইরের কয়েকজনের সঙ্গে মিলে কোরবানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাকির জানান, গরুর মূল্যবৃদ্ধি ও এনজিওর চাকরি হারানোয় এবার আর তিনি কোরবানি দেবেন না। তিনি বলেন, ‘বাজারে এবার ছোট গরুর চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি। মধ্যবিত্তের জন্য এবার কোরবানি দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’
ঈদুল আজহার আর সপ্তাহখানেক বাকি। দেশের প্রায় সব হাটে খামারিরা গরু আনলেও বেচাবিক্রি জমে ওঠেনি। বৈরী আবহাওয়ায়ও গরু নিয়ে হাজির হচ্ছেন বিক্রেতারা। পাইকারেরা হাতেগোনা কিছু গরু কিনছেন। কিন্তু স্থানীয়রা বাজারে এলেও দাম দেখে না কিনে ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভাগে কোরবানি করার জন্য অংশীদার খুঁজছেন। হাটসংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার বাজারে বড় ক্রেতা নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রংপুর বিভাগে এবার ২১ লাখ ৫২ হাজার ৩১৯টি পশু বিক্রির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চাহিদা মিটিয়ে আরো আট লাখ পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। তবে বাজারে নেই বিক্রি। রংপুর নগরীর খামারি আরমানুর রহমান লিংকন ২০০-৮০০ কেজি ওজনের চারটি গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছেন। তবে এখনো কয়েকজন ক্রেতা খামারে এলেও কাঙ্ক্ষিত দাম বলেননি। যার কারণে গরু বিক্রি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তার। তবে লোকসানে গরু বিক্রি করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
ময়মনসিংহের খামারি আব্দুল খালেক আটটি বড় গরু নিয়ে স্থানীয় চুরখাই বাজারে এসেছেন। তিনদিন পার হয়ে গেলেও এখনো একটিও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে ক্রেতা আসছেন। অনেকে দামদর করছেন। তবে কেউ গরু কিনছেন না। সবাই শুধু দেখে চলে যাচ্ছেন। বড় গরুর ক্রেতা এখনো বাজারে আসেননি। মধ্যবিত্তরা গরু দেখছেন, কিন্তু তাদের বাজেট কম। ৬০-৭০ হাজারের মধ্যে গরু কেনার আগ্রহ তাদের। এবার সবকিছুর দাম বাড়ায় গরু মোটাতাজাকরণের খরচও বেশি পড়েছে। গরুগুলো বিক্রি না হলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
এবার পশু কেনা কমার কারণ হিসেবে জানাতে গিয়ে কুষ্টিয়া সদরের খামারি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে কোরবানির সময় গরু বিক্রি করছেন। লাভ-ক্ষতির মধ্য দিয়েও টিকে আছেন। গত বছরের তুলনায় এবারের চিত্র একটু ভিন্ন। বাজারে ক্রেতা নেই। আর প্রতি বছর যাদের ক্রেতা হিসেবে দেখে আসছিলেন তারা এবার নেই। এমনকি তার পরিচিত অনেকেই এবার বাজারে নেই।
বাজারের এমন অবস্থার জন্য রাজনীতিবিদদের বাজারে না আসাকে কারণ হিসেবে দেখছেন একই জেলার আরেক ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ধনী রাজনীতিকদের বড় একটি অংশ এবার হাটে আসছেন না। তারা প্রতি বছরই আট-১০টি পশু কেনেন। কিন্তু এবার তাদের দেখা নেই, যার কারণে বড় গরু বিক্রি হচ্ছে না।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের কোরবানির জন্য ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার কোরবানির পশু প্রস্তুত করা রয়েছে। দেশে পশুর চাহিদা ১ কোটি ৪ লাখ। দেশের তিনটি বিভাগ থেকে এবার ৭০ শতাংশ পশুর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তার মধ্যে রাজশাহীতেই রয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার ও খুলনা বিভাগে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার পশু। এবারের কোরবানিতে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার পশু কোরবানি দেয়া হবে হিসাব কষেছে অধিদপ্তরটি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বয়জার রহমান বলেন, ‘এবার আমাদের চাহিদার চেয়ে ২০ লাখ গরু উদ্বৃত্ত রয়েছে। এবার যেহেতু বিদেশী গরু ঢুকবে না, তাই দেশের চাহিদা দেশী পশুই মেটাতে পারবে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, চাহিদার চেয়ে ২০ লাখ পশু বেশি থাকলেও কোরবানি দিতে পারছেন না অনেক মধ্যবিত্ত। কয়েক বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে তাদের। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনলেও এখনো তা ৯ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ছয় মাসের মধ্যে গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে কম। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর আগে মার্চে ৯ দশমিক ৩৫, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৩২, জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ৯৪ ও ডিসেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দারিদ্র্যের হারও বেড়ে চলছে।
গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ২০২৫ সাল শেষে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হারের হিসাবে গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৯০ লাখের মতো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে উঠবে। জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরের সাড়ে ২০ থেকে বেড়ে এবার ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একদিকে মূল্যস্ফীতি, নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দেশী-বিদেশী বিনোয়োগ কমে যাওয়া এবং কর্মসংস্থান কমার কারণে মানুষের আয় কমেছে। অন্যদিকে মানুষের আয় কমলেও বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ থেকে পালিয়েছেন তৎকালীন এমপি-মন্ত্রী, সরকারঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পর্যায়ের উচ্চবিত্ত নেতারা; যারা ছিলেন কোরবানি ঈদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বন্ধ হয়েছে অনেক কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কর্মসংস্থান হারিয়েছে লাখো মানুষ। কোরবানি সামনে রেখে গরু, মহিষ ও ছাগলের দাম বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়েছে। ফলে মধ্যবিত্তের অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এবারের কোরবানি।
ময়মনসিংহের সাখুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদ উদ্দিন প্রতি বছর ৭০-৮০ হাজার টাকা দামের গরু কিনে কোরবানি দিলেও এবার দেবেন না। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, এতে কোরবানি করা এবার সম্ভব না।’
কুড়িগ্রামের রফিক মিয়া ঢাকায় একটি কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সাত-আট মণ ওজনের গরু কোরবানি দিলেও এবার আরো কম ওজনের গরু কিনবে। আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে চাহিদার সংগতি নেই। পরিবার বড় হলে খরচও বাড়ে। এখন থেকে কোরবানির বাজেট হয়তো কমাতে হবে।’
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে এবার কোরবানি দেবেন না রংপুরের ধাপ এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এবার খরচ একটু বেশি হয়ে গেছে। আর যে আয় তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া আর পরিবারের খরচ চালানো কঠিন। গতবার একটি গরুতে এক ভাগ দিলেও এবার সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোরবানি করব না।’
ঈদের ছয়দিন আগেও ক্রেতা-বিক্রেতারা দুশ্চিন্তায় থাকলেও বাজার সহনশীল হবে বলে মনে করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. বয়জার রহমান। তিনি বলেন, ‘এবার বাজার সহনশীল থাকবে। তবে বাজার নিয়ে অনেকের অনেক ধারণা আছে। কেউ বলছে রাজনৈতিক নেতারা সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশি গরু কিনবেন। আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে এবার পশুর চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটা ভারসাম্য আছে। বাজারে কোনো ধরনের নেতিবাচক সমস্যা হবে না।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এবার বর্ডার দিয়ে কোনো পশু আসতে পারবে না।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান মনে করেন, এবার পশুর চাহিদা কম থাকবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর ৫ শতাংশ কোরবানি পশুর চাহিদা বাড়ে। যখন আর্থিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে তখন এটা কম থাকে। এবার উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিম্ন, যার অর্থ হচ্ছে মানুষের আয় কম। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানি ঈদে কার্যকরী চাহিদা কম হবে। এছাড়া আওয়ামীপন্থী রাজনৈতিক নেতারা বড় বড় গরু কোরবানি করত, এবার সে রকম লোক নেই। কাজেই চাহিদা কম থাকবে। অনেকে গরু ভাগে, না হয় ছাগল দিয়ে কোরবানি করবে। এর কারণ মানুষের আর্থিক ক্ষমতা কমে গেছে।’
এবার পশুর দাম বাড়বে না বলে ধারণা প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এ মহাপরিচালকের। তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে এবার গরুর দাম খুব বেশি বাড়বে না। গতবার ৫-৭ শতাংশ দাম বেড়েছিল। এবার প্রথম দিকে দাম বেশি হতে পারে, কারণ খামারির ব্যয় বেশি হয়েছে। তবে দাম বেশি হলে মানুষ কিনবে না। তখন অবিক্রীত থেকে গেলে খামারিরা লোকসানে পড়বে। খামারিরা কম লাভ করে বিক্রি করে দিলে বেশি বিক্রি হবে।’
*প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও মাদারীপুর প্রতিনিধি।