শামসুর রাহমান এর জন্মদিন আজ

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের এই দিনে (২৩ অক্টোবর) ঢাকার মাহুতটুলীর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিষয় প্রকরণ ও কাব্যভাষার জন্য তিনি বিখ্যাত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লেখা তার দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয়।
শামসুর রাহমানের বাবার নাম মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরার পাড়াতলীতে। ১৯৪৫ সালে পুরান ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে তিন বছর নিয়মিত ক্লাস করেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষপর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।
১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক মর্নিং নিউজে। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এর পর আবার ফিরে আসেন মর্নিং নিউজে। সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানের (স্বাধীনতা উত্তর দৈনিক বাংলা) সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ‘অধুনা’ নামে মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শামসুর রাহমান ১৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ওই বছর নলিনী কিশোর গুহ সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায় ‘উনিশশ ঊনপঞ্চাশ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালে ১৩ জন তরুণ কবির কবিতার সঙ্কলন ‘নতুন কবিতা’য় পাঁচটি কবিতা স্থান পায়। ‘নতুন কবিতা’ আশরাফ সিদ্দিকী ও আব্দুর রশীদ খানের সম্পাদনায় পূর্ববাংলার প্রথম আধুনিক সাহিত্য সঙ্কলন। ১৯৬০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কবিতা তাকে বেশি পরিচিত করে তোলে।
বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে শামসুর রাহমানের ব্যবহৃত ছদ্মনাম হল- সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়। ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ‘হাতির শুঁড়’ কবিতাটি লেখেন। শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দী থাকাকালে তাকে উদ্দেশ করে লেখেন ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে) কবিতাটি। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত থাকা অবস্থায়ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান। এর প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী বিবৃতি দেন, যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমান। কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলে লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লেখেন ‘আসুন আমরা আজও একজন জেলে’ কবিতাটি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে লেখেন বিখ্যাত দুই কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। ১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
শামসুর রাহমানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৬৬, উপন্যাস ৪, প্রবন্ধগ্রন্থ ১, ছড়ার বই ১ ও অনুবাদ ৬টি। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। অন্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজ বাসভূমে (১৯৭০), বন্দিশিবির থেকে (১৯৭১), বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭) ও ইকারুসের আকাশ (১৯৮২)।
তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। উল্লেখযোগ্য হল- আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৭৭), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮১), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮১), ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), পদাবলী পুরস্কার (১৯৮৪) এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯২)। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে জাপানের মিতসুবিশি পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে কলকাতায় আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছর সাম্মানিক ডিলিট দেয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৬ সালে ডিলিট উপাধী দান করে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী।
১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন শামসুর রাহমান। এ দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে।
শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় মারা যান।