প্রবাসী আয়ে ভর করে এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার
দেশের প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ফলে এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭৮০ কোটি বা ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল প্রায় ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ২৪ ডিসেম্বর তা ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালান্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) পদ্ধতি অনুসারে, বর্তমানে রিজার্ভ ২৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি উৎস রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে ১৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা গেলেও রফতানি আয় খুব বেশি গতিশীল নয়। যদিও ২০২৪ সালের তুলনায় রফতানি আয় এখনো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের এ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের বর্তমান রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। এদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২১২ কোটি ডলারে।
গত বছরের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকেই বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। এর পরও চলতি ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত রিজার্ভে খুব বেশি উন্নতি দেখা যায়নি। মূলত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদেশী অনুদান এবং মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ কমে যাওয়ার প্রভাবেই দেশের রিজার্ভ চাপে পড়েছিল। বছরের মাঝামাঝি এসে এফডিআই, বিদেশী অনুদান ও ঋণে প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়। এর ওপর ভর করে দেশের আর্থিক হিসাবেও উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এতে রিজার্ভও কিছুটা স্থিতিশীল হয়। একই সঙ্গে চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও কিছুটা স্বস্তি আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সার্বিক বিওপিতেও ২১৯ কোটি ডলার ঘাটতি থাকলেও চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের একই সময়ে সেখানে উদ্বৃত্ত আছে ১০৮ কোটি ডলার। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা রাষ্ট্রের আর্থিক হিসাবেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে যেখানে আর্থিক হিসাবে ৪৯ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে ২১৭ কোটি ডলার।
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে দেশে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কভিড-১৯ মহামারীর সময় ২০২০ সালে আমদানিতে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে তখনো বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এর প্রভাবে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের প্রবাহ বেড়ে যায়। বিনিময় হার ধরে রাখতে বাজার থেকে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাড়তে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ফলে ২০২১ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রিজার্ভ দেখে বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর থেকেই ক্ষয় শুরু হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির চাপে পড়ে রিজার্ভ। একই বছরে দেশ থেকে টাকা পাচারও অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এর প্রভাবে ক্ষয় হতে শুরু করে রিজার্ভ।
ওই সময় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে তৎপর হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। এর প্রভাবে গত বছরের জুলাইয়ে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণও ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হলে দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে আসে। বিপরীতে বড় প্রবৃদ্ধি পায় দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি নয়, বরং বাজার থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত ২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে। এর প্রভাবে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে গত ২৪ ডিসেম্বরে ৩২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একই দিন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তথা বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভের স্থিতি ছিল ২৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।


