একটি শান্তিপ্রিয় দেশ চান ভাষাসৈনিক চৌধুরী আব্দুল হাই
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় সংগ্রামী মনোভাব। যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামই তাকে হাতছানি দিতো। স্পৃহা সৃষ্টি করতো। তাই মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হয়েও ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট চৌধুরী আব্দুল হাই।
সেসময় চষে বেড়ান পুরো জেলার (তৎকালীন মহকুমা) প্রতিটি স্কুল। ভাষা আন্দোলন বেগবান করতে ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন কমিটি।
সংগ্রামী এ মানুষটির জন্ম ১৯৩৯ সালে। জেলা শহরতলীর বড় বহুলা গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাইয়ের মাঝে তিনি তৃতীয়। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে আইএ ও বিএ পাস করেন বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন।
এলএলবি পাস করার পর পাকিস্তান সরকারের আমলে মুন্সেফ পদে নিয়োগ পান। পদায়ন হয় কুমিল্লায়। তখন তিনি পত্র দিয়ে চাকরি করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে হবিগঞ্জে আইন পেশায় যোগ দেন। ইতোমধ্যে এ পেশায় প্রায় ৫৫ বছর অতিবাহিত করেছেন তিনি।
তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে আমেরিকা প্রবাসী। তিনিও সন্তানদের কাছ থেকে দেশে ফিরেছেন জানুয়ারির শুরুর দিকে।
১৯৮৬ সালে তিনি ন্যাপ (মোজাফফর) থেকে হবিগঞ্জ-লাখাই আসনে এমপি নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত।
ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট চৌধুরী আব্দুল হাই বলেন, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। মূলত তখনই স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছিল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা অনুভব করেছিলাম যে আমাদের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একদিন আমাদের স্বাধীন হতেই হবে। অন্যথায় পরাধীনতা আমাদের পিষে মারবে।
চৌধুরী আব্দুল হাই জানান, ১৯৫২ সালে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। পড়তেন অষ্টম শ্রেণিতে। তখনই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। দেশব্যাপী ছাত্রদের সংগঠিত করতে কাজ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র হবিগঞ্জে আসেন। তিনি ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাধে তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের কয়েকজনকে নিয়ে কোর্ট স্টেশনে বৈঠক করেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
আন্দোলনের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ছাত্রনেতা (মরহুম) সৈয়দ শফিক উদ্দিন আহমেদকে। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান চৌধুরী আব্দুল হাই। এরপর থেকেই তারা চষে বেড়ান বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনের জন্য কমিটি গঠন করেন। প্রতিটি স্থানেই অভুতপূর্ব সাড়া পান তারা। তাদের ডাকে আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হন সর্বস্তরের মানুষ।
তিনি বলেন, তখন অনেকেই বলতেন মাওলানারা আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে থাকবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল পুরো উল্টো। প্রকৃপক্ষে তারাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমাদের পরামর্শ দিতেন। সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। মানুষের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। এ আন্দোলনই মূলত স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এখন নিজেকে ধন্য মনে করছেন। তিনি বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দেশ এখন বেশ ভালোই চলছে। আমারও বেশ ভালো লাগে। আমি চাই যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা আন্দোলন করা হয়েছিল তা যেন সফল হয়। দেশ যেন একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হয়।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশকে জানতে হবে। ইতিহাস জানতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। বাংলাকে ভালোবাসতে হবে। দেশের যা দুর্বলতা আছে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই এ দেশ সত্যিকারের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য সার্থক হবে।