শিরোনাম

South east bank ad

‘আয়নাবাজি’র মতো আসামি বদল, ছিল দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা

 প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারী ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর কদমতলীতে টিটু নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যায় দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সোহাগ ওরফে বড় সোহাগকে (৩৪)। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। পরে ২০১৪ সালের ১৬ মে জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।

২০১৭ সালে পলাতক থাকা অবস্থায় সোহাগের যাবজ্জীবন সাজা দেন আদালত। এরপরের গল্পটা যেন ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার কাহিনি। নিজেকে বাঁচাতে এবং দেশ থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে আসামি হিসেবে হোসেন নামের আরেক ব্যক্তিকে আদালতে পাঠান সোহাগ। এজন্য চুক্তি হয় মাসিক পাঁচ হাজার টাকা। আদালত হোসেনকে ‘সোহাগ ভেবে’ জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। অন্যদিকে আসল আসামি সোহাগ দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতারণার আশ্রয় নেন। নিজের পিতার নাম পরিবর্তন করে বাগিয়ে নেন এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট।

তবে বিষয়টি বুঝতে পেরে আসল সোহাগকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে আসছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সবশেষ শনিবার (২৯ জানুয়ারি) টিকা দিতে এসে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে সোহাগকে গ্রেফতার করেন র‌্যাব-১০ এর সদস্যরা।

আজ রোববার (৩০ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহফুজুর রহমান এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর কদমতলী থানার আউটার সার্কুলার রোডে হুমায়ুন কবির ওরফে টিটু নামে একজন গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ওই ঘটনায় তার পরিবার কদমতলী থানায় একটি হত্যা মামলা করে। তাতে আসামি করা হয় সোহাগ ওরফে বড় সোহাগসহ (৩৪) আরও তিন-চারজনকে।

ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হয়ে জেলে যান সোহাগ। কারাগার থেকে ২০১৪ সালের ১৬ মে জামিনে বেরিয়ে পলাতক জীবনযাপন শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মামলার এক নম্বর আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ পলাতক থাকতেই আদালত রায় দেন। রায়ে সোহাগ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় আসামি পাল্টে ফেলেন সোহাগ আদালতের রায়ের পর সোহাগ নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে থাকেন। পরিকল্পনা করেন আসামি পরিবর্তনের মাধ্যমে জামিন পাওয়ার। বাল্যকাল থেকে সোহাগের সঙ্গে সখ্য ছিল ফুফাতো ভাই হোসেনের (৩৫)। জামিন না পেলেও অন্তত নিজে আড়ালেই থাকবেন, এমন পরিকল্পনায় সোহাগ মাসিক পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে ফুফাতো ভাই হোসেনের সঙ্গে চুক্তি করেন। পাশাপাশি সোহাগ নিজের পরিবর্তে হোসেনকে জেলহাজতে পাঠানোর আগে আশ্বস্ত করেন যে, দুই-তিন মাসের মধ্যে বের করে নিয়ে আসবেন।

আদালত কারাগারে পাঠান নকল সোহাগকে চুক্তি অনুযায়ী মাদকাসক্ত হোসেন নিজে সোহাগ সেজে আত্মসমর্পণ করে আদালতে জামিন আবেদন করেন। মো. হোসেনের বাবার নাম হাসান উদ্দিন। সোহাগের বাবার নাম গিয়াস উদ্দিন। আদালত আসামি বদল বা নকল সোহাগকে চিনতে না পারলেও জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। এরপর থেকেই কারাগারে থাকেন নকল সোহাগ অর্থাৎ হোসেন। আর আসল সোহাগ রয়ে যান আড়ালেই।

এক সাংবাদিক বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন নকল সোহাগের জেল খাটার বিষয়টি সর্বপ্রথম আদালতের সামনে আনেন এক সাংবাদিক। আদালত তা আমলে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চান। প্রতিবেদনে ২০১০ সালে প্রথম গ্রেফতার হওয়া সোহাগের তথ্য ও শনাক্তের বিবরণীর সঙ্গে কারাগারে থাকা নকল সোহাগের অমিল পেলে তা আদালতকে জানানো হয়। আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের রিপোর্টেও নকল সোহাগের জেল খাটার সত্যতা মেলে।

২০২১ সালের আগস্ট থেকে আসল সোহাগকে খোঁজা শুরু করে র‌্যাব কারাগার ও পুলিশের প্রতিবেদনে নকল সোহাগের জেল খাটার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর বিশেষ দায়রা আদালত ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ প্রকৃত সোহাগের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এর একটি অনুলিপি পান র‌্যাব-১০ অধিনায়ক। এরপর ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে র‌্যাব-১০ এর অপারেশন টিম ও সদর দপ্তরের গোয়েন্দার একটি টিম আসল সোহাগের খোঁজে তদন্ত ও অভিযান শুরু করে।

টিকা নিতে এসে ধরা পড়েন আসল সোহাগ দীর্ঘ তথ্যানুসন্ধান ও গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব জানতে পারে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য টিকার ডোজ পূরণ ও টিকা কার্ড সংগ্রহ করতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় আসবেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে টিটু হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

এনআইডি কার্ডে বাবার নাম পরিবর্তন প্রকৃত বা আসল সোহাগ যাবজ্জীবন কারাভোগের বিষয়টি জানার পর নিজের বাঁচার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি সুকৌশলে দেশত্যাগের চেষ্টা শুরু করেন। দেশ ছেড়ে পালাতে এনআইডি কার্ড সংশোধন করে বাবার নাম গিয়াস উদ্দিনও ওরফে কাঙ্গালের জায়গায় মামা শাহ আলমের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে ১০ হাজার টাকা খরচ করে দালালের সহযোগিতায় পাসপোর্ট তৈরি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সংগ্রহ করেন। মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে ভিসা করতে তিনি খরচ করেন আরও ৫০ হাজার টাকা।

কোডিভ পরিস্থিতি কাল হয় আসল সোহাগের জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ ছাড়ার প্রায় সব প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করেন হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সোহাগ। তবে করোনা পরিস্থিতি ফের খারাপ হওয়ায় দেশত্যাগে করোনার টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এটিই কাল হয় সোহাগের। শনিবার করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিতে ঢাকায় আসেন। এরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়।

১০ মামলার আসামি সোহাগ এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, মামলার বিবরণ অনুযায়ী আসল সোহাগ অটোচালক হলেও তিনি মূলত পেশাদার অপরাধী। জিজ্ঞাসাবাদে ও তদন্তে জানা গেছে, প্রকৃত আসামি সোহাগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় দুটি হত্যা মামলা, দুটি অস্ত্র মামলা ও ছয়টি মাদক মামলাসহ ১০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনি টিটু হত্যাসহ দুটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।

এনআইডির তথ্য সংশোধন ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-১০ অধিনায়ক বলেন, আমরা প্রথমত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসল অপরাধীকে গ্রেফতার করলাম। এখন ওই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি দেখভাল করবেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে র‌্যাব সদর দপ্তর যদি মনে করে এ চাঞ্চল্যকর মামলাটি র‌্যাবের তদন্তাধীন বিষয়, তাহলে আবেদন করে মামলার তদন্তভার চাওয়া হবে।

কীভাবে আসল সোহাগের পরিবর্তে নকল সোহাগ আদালতে জামিন চাইলেন এবং কারাগারে গেলেন, এসবের পেছনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আইনজীবীর দায় খোঁজা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতে আসামি বদলে ফেলার বিষয়টি ধরতে পারা কঠিন বিষয়। তবে এক্ষেত্রে কারাগার অবশ্যই পারে।

কারণ তাদের কাছে ডাটাবেজ আছে এবং আসামি শনাক্তকরণের বিবরণীও সংরক্ষিত আছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত আসামির আইনজীবী জেনেই নকল সোহাগের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। তার দায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চয় খুঁজবেন।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: