কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লী, দরকার স্থায়ী ব্যবস্থা
সুনান বিন মাহাবুবম, (পটুয়াখালী) :
কুয়াকাটার স্থাণীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে এই মৌসুমে প্রতিটি আড়তে প্রায় ৩০ ধরনের মাছের শুঁটকি থাকে। বর্তমান বাজারে আছে প্রায় ১৬ টির মতো আইটেম। কলাপাড়া-কুয়াকাটায় লইট্টা, ফাইসা, ছুড়ি, পোমা, রূপচাঁদা, ইলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। তবে কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লীর সব স্বাভাবিক থাকলেও বর্তমানে ক্রেতা কম, তাই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে শুঁটকির।
জানা গেছে, বর্তমান কুয়াকাটায় বেশ কয়েকটি শুঁটকি মাছের বেশি চাহিদা রয়েছে। আর সেগুলোর দাম পূর্বের চাইতে অনেক বেশি। চাহিদার শীর্ষে থাকা ছুড়ি মাছের শুঁটকি ২৫০-৩০০ টাকা কেজি, লইট্টা মাছের শুঁটকি ৩৫০ টাকা, ফাইসা মাছের মাছের শুঁটকি ১৮০-২২০ টাকা, পোমা মাছের শুঁটকি ৩৫০-৪৫০ টাকা, রুপচাঁদা মাছের শুঁটকি ৩৫০ টাকা থেকে শুরু এবং ইলিশ ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলার কলাপাড়া উপজেলায় প্রতি মৌসূমে শুটকি উপাদিত হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ মেটিক টন। এই মৌসূমে কলাপাড়া উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন এবং কুয়াকাটায় ১২-১৫ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদিত হয়েছে। কুয়াকাটার আশেপাশে প্রায় ৪০ টি অস্থায়ী শুঁটকি পল্লী রয়েছে। সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে কিছুদূর পশ্চিমে গেলেই সৈকতে অবস্থিত সারি সারি শুঁটকির মাঁচা। বছরে ৪ থেকে ৫ মাস এখানেই শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। প্রায় ২০ টি পরিবার স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে শুঁটকি ব্যবসা পরিচালনা করে এখানে। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর রয়েছে ১০-১২ জন করে শ্রমিক। এদিকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কুয়াকাটায় অবৈধ জালের ব্যবহার বেশী। এ কারণে সাগরে মাছ কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ৮-১০ লাখ টাকা পূঁজি নিয়ে শুটকি ব্যবসায় নামেন। বাঁশের মাঁচা তৈরি করতে হয় মাছ শুকানোর জন্য। জাল-নৌকা কিনতে হয়। আগে এই পূঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা অনেক লাভবান হতেন। কিন্তু এখন লোকসানের মুখ দেখছেন তারা। মাছগুলোকে বাছাই করে বিভিন্ন শ্রেনীতে আলাদা করা, ময়লা ছাড়ানো, মাছ কেটে শুকাতে দেয়া, রোদে একাধিকবার মাছগুলোকে উল্টে দেয়া, শুকানো হলে গুছিয়ে শুঁটকিগুলোকে ঘরে তোলা, শুঁটকিগুলোকে প্যাকেট করা সহ হরেক কাজে প্রতিদিন অনেক শ্রমিক পরিশ্রম করে। কিন্তু সারাদিন কাজ করে যতটা পারিশ্রমিক পাবার কথা তেমন পাচ্ছে না। জেলেরা জানিয়েছেন, আগে সারা দিনে জাল ফেলে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যেত। এখন কয়েকবার জাল ফেলেও মাছও ধরা যায়না। সব মাছ যায় কারেন্ট জালে। এসব জালের কারনে সাগরের মাছ সহ সবধরনের জলজ প্রানি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা দেখা গেছে, কুয়াকাটার শুটকি পল্লীর মাছে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয় না। প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়ে করা হয় বাজারজাত। ফলে এর রয়েছে আলাদা স্বাদ। তবে এখানে স্থায়ী শুটকি পল্লী নেই। তবুও বছরের পর বছর চলছে শুটকির ব্যবসা। স্থায়ী পল্লীর ব্যবস্থা না থাকায় বাজারজাতকরণেও রয়েছে অনেক সমস্যা। পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার কারণে শুটকি পল্লী সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যত্র। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্টের পূর্বদিকে গঙ্গামতির চরের বনের ধারে রয়েছে একটি শুটকি পল্লী। অন্যদিকে পশ্চিম দিকে রয়েছে ২টি শুটকি পল্লী। শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কম। প্রায় হাজার পরিবার কলাপাড়া-কুয়াকাটায় শুটকি ব্যবসার মধ্য দিয়ে আয় করছে লাখ লাখ টাকা। কুয়াকাটায় আসা পর্যটকদের কাছে প্রতিদিন শতাধিক কেজি শুটকি বিক্রি করছে এসকল ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত কয়েকবছর পূর্বে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় ছিল অনেক বড় শুটকি পল্লী। মাছধরা, মাছ শুকানো, আর শুটকি বাজারজাতকরণে শত শত শ্রমিক কাজ করতো। কিন্তু এখন সে চিত্র বদলে গেছে। এছাড়াও স্থায়ী পল্লীর ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের শুরুতে কোথাও শুটকি উৎপাদনের আয়োজন করা হলে হঠাৎ করেই পল্লী উচ্ছেদ করা হয়। এভাবে শুটকি ব্যবসায়ীরা বার বার লোকসান দেওয়ার কারণে অনেকে ব্যবসায়ে আগ্রহ হারাচ্ছে। শুটকি ব্যবসায়ী আকন তালুকদার বলেন, মৌসুমের শুরুতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু পর্যটক এলাকা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং স্থায়ী পল্লীর ব্যবস্থা না থাকায় দীর্ঘদিন ব্যবসায় লোকসান দিতে হয়েছে। এখন আবার কারেন্ট জালের ব্যবহারে সমুদ্রে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। কুয়াকাটায় শুটকি পল্লী থাকলেও নেই কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে স্থায়ীভাবে শুটকি পল্লী ও বিক্রয়ের জন্য স্টল করে দিলে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা করলে তবেই এখান থেকে শুটকি উন্নত বিশ্বে রফতানি করা সম্ভব।
তবে কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার জানিয়েছেন, কুয়াকাটার শুটকি ব্যসায়ীদের নিজস্ব পল্লীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুঁটকি বিক্রির জন্য স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এসকল স্টলে শুঁটকি বিক্রি করছে বর্তমানে। এদিকে জেলা মৎস অফিস থেকে জানানো হয়েছে, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহারের সাগরে অন্যান্য মাছ মরে যাচ্ছে। ফলে সামুদ্রিক মাছ কম পাওয়া যায় এখন। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য সহ অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জাল আটক করে বিনষ্ট করা হচ্ছে। কলাপাড়া, মহিপুর অঞ্চলের আরতদারদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, কাঁচা মাছের প্রচুর আমদানি হওয়ায় শুঁটকি মানুষ খেতে চায় না। তবে বৈশাখে শুঁটকির সিজন শুরু হলে কুয়াকাটার ব্যবসায়ীদের বেঁচা-কেনা ভালো হবে।
স্থানীয় শুটকি ব্যবসায়ী ইমাম বলেছেন, কুয়াকাটার পর্যটকদের কাছে ছুড়ি, লইট্টা এবং চিংড়ির চাহিদা সব থেকে বেশি। কুয়াকাটার শতাধিক শুঁটকির দোকানে সারা বছরই বেচা বিক্রি চলে। তবে স্থায়ী কোন জায়গা না থাকায় শুঁটকি উৎপাদনে সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। যার ফলে লাভ লোকসানের মধ্য দিয়েই চলছে তাদের এই ব্যবসা।