রাবি ক্যাম্পাসেই চিরনিদ্রায় শায়িত ‘ছোট গল্পের বরপুত্র’
আমজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী ব্যুরো):
অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলা ছোট গল্পের বরপুত্র উপমহাদেশের প্রখ্যাত কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গল্পের যাদুকরের নামাজে জানাজা শেষে গ্রন্থাগারের পশ্চিম পাশে তাকে শায়িত করা হয়।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় প্রয়াত এই প্রথিতযশা সাহিত্যিকের মরদেহ বিশ্ববিদালয় হাউজিং সোসাইটির (বিহাস) নিজ বাসভবন ‘উজান’ থেকে তাঁর প্রিয় দর্শন বিভাগে নেওয়া হয়; সেখানে যৌবণ থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত শিক্ষকতা জীবন অতিবাহিত করেছেন। এরপর দুপুর ১২ টায় প্রিয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে প্রিয় লেখকের নিথর দেহ নিয়ে আসা হয়। যেখানে আগে থেকেই প্রিয় লেখককে শেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় চিরবিদায় জানাতে তাঁর হাজার হাজার শুভানুধ্যায়ী-শুভাকাঙ্খী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এই লেখকের লাশবাহী কফিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে রাখতেই তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অশ্রুশিক্ত নয়নে তাঁকে সবাই জানায় চিরবিদায়।
একে এক শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে হাসান আজিজুল হকের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মব্যক্তি, রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল জলিল, রাজশাহী-০২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা; বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা তার ভক্তরা প্রিয় লেখকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এসময় তার জীবন-কর্মের ওপর অনেকেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে স্মৃতিচারণ করেন। এমনি একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু। তিনি বলেন, ‘আগুনপাখির’ চিরবিদায়ে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। যেই ক্ষতি দেশ আর কখনো পুষিয়ে নিতে পারবে না। তারপরও মৃত্যু যেহেতু অমঘ। তবে তিনি তাঁর ৮২ বছরের জীবনে আমাদের জন্য মূল্যবান অনেক কিছুই রেখে গেলেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। এগুলোই অনাদিকাল হাসান আজিজুল হককে চির স্মরণীয় করে রাখবে।’
পরে রাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রখ্যাত এ কথাসাহিত্যিকের জানাজায় অংশ নেন রাবির উপাচার্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সকালে কথাসাহিত্যিকের শেষ গোসলের কাজ সম্পন্নের পর কাফনে জড়ানো কফিন রাখা হয় তাঁর বাসার সামনে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাড়াও কবি-সাহিত্যিক এবং ভক্তরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তাঁরা হাসান আজিজুল হকের জীবনের নানা দিক নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে বিশ্ববিদালয় হাউজিং সোসাইটির (বিহাস) নিজ বাসভবন ‘উজান’-এ উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে হৃদযন্ত্রের সমস্যার বাইরেও ফুসফুসে সংক্রমণ, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ তার শারীরিক অবস্থার অবণতি হলে গত ২১ আগস্ট এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে রাজশাহী থেকে তাকে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে নিজ বাড়িতেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। তার বাবার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ এবং মায়ের নাম জোহরা খাতুন। ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। জীবনের বেশিরভাগ সময় তার রাজশাহীতে কেটেছে। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ (রাজশাহী কলেজ) থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজ অধ্যাপনা করেন।
১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন হাসান আজিজুল হক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে নগরের চৌদ্দপায় এলাকার আবাসিক এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন এই কথাসাহিত্যিক।
হাসান আজিজুল হক ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য জীবনে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৬৭ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি পান হাসান আজিজুল হক। এছাড়া বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশিচমবঙ্গ), অমিয়ভূষণ সম্মাননা (জলপাইগুড়ি), সেলিম আল দীন লোকনাট্য পদক, শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।