ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ : শিক্ষকের প্রেমের ফাঁদে কিশোরীর সর্বনাশ
ফয়সাল আহমেদ, (গাজীপুর) :
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বড়িবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাছির উদ্দিন সেলিম। নিজের বিয়ের পাত্রী দেখার জন্য গিয়েছিলেন একই জেলার শ্রীপুর উপজেলার ধামলই গ্রামে। বিয়ের পাত্রী ছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পাত্রী পছন্দ হয়েছে বলে বিয়ের প্রলোভন দেখান এই শিক্ষক। কিছুদিন পরই বিয়ে করে ঘরে নেয়ারও আশ্বাস দেয় কিশোরীর পরিবারকে। এর ফাঁকেই এই কিশোরীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেন তিনি। বেশ কিছুদিন পর বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন কিশোরীকে। কিশোরী তার প্রস্তাব না করে দেন। এরই মাঝে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে অভিযুক্ত শিক্ষক আসে কিশোরীর বাড়ীতে। সেখানে আলাপ আলোচনার ফাঁকে কিশোরীকে একা ঘরে ডেকে নেন। উভয়ের কথাবার্তার মধ্যেই ঘরের দরজা বন্ধ ধর্ষণের চেষ্ঠা চালান অভিযুক্ত। পরে কিশোরীর চিৎকারে তার স্বজনরা এসে তাকে উদ্ধার করেন, পালিয়ে যায় অভিযুক্ত।
অভিযুক্ত নাছির উদ্দিন সেলিম কাপাসিয়া উপজেলার বিবাদিয়া গ্রামের মৃত মান্নানের ছেলে। সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত ১৪এপ্রিল অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে শ্রীপুর থানায় অভিযোগ দেন কিশোরী। ওই দিনই অভিযোগটি মামলা হিসেবে রুজু করে পুলিশ। দ্রুত মামলাটির তদন্ত করে দুমাসের মধ্যেই আদালতে অভিযোগ পত্র দায়ের করে পুলিশ। যেখানে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয়েছে বলে পুলিশ উল্লেখ করেন। যদিও এরই মধ্যে কয়েকমাস অতিবাহিত হলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি কর্তৃপক্ষ। উপরোন্ত এই শিক্ষক এখন প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গাজীপুরে প্রশিক্ষনার্থী হিসেবে প্রশিক্ষণে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
কিশোরীর পরিবারের ভাষ্য মতে, বিয়ের আলোচনার মধ্যেই অভিযুক্ত শিক্ষক কৌশলে কিশোরীর মুঠোফোন নাম্বার নেয়। পরে সে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী করে। এসময় সে কিশোরীকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। সবকিছুই ঠিক ছিল শুধু বিয়ের তারিখের অপেক্ষা। এরই মধ্যে অভিযুক্ত কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় কিশোরীটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, ভেঙ্গে যায় তার বিয়ে।
কিশোরীর বাবার ভাষ্য মতে, একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ আমরা আশা করিনি। তার জন্যই এখন তার মেয়ের জীবন অনিশ্চিত। তারা সামাজিক ভাবে হেয় হয়েছেন এই শিক্ষকের কারণে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে তারা থানায় মামলা করেছেন, বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। উল্টো বিচার তো পাননি, প্রতিনিয়ত তাদের দেখে নেয়ার হুমকী দেন এই শিক্ষক।
এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও অভিযুক্তকে পাওয়া যায়নি। তবে তার ভাই সিংহশ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লুৎফর রহমান বলেন, এ ঘটনার পর থেকেই তার ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই, তার মুঠোফোনও বন্ধ। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে, তাই সেখানেই ফয়সালার অপেক্ষায় তারা। তবে তিনি কিভাবে প্রশিক্ষণ সহ স্বাভাবিক কাজে অংশ নিচ্ছেন এ বিষয়ে তারা কিছুই অবহিত নন বলে জানান।
কাপাসিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) সানজিদা আমিন বলেন,গত ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০সালে এই শিক্ষক চাকুরীতে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তাকে বড়িবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়। এর কিছু দিন পরই করোনার কারণে বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের জানুুয়ারী থেকে তাকে প্রশিক্ষনের জন্য গাজীপুর পিটিআইয়ে ছাড়পত্র দেয়া হয়। এর পর থেকে তার কোন খোঁজ তিনি পাননি। এছাড়াও তার চাকুরীকালীন সময় দুই বছর অতিবাহিত না হওয়ায় এখনো এ শিক্ষকের চাকুরী স্থায়ী হয়নি। তবে এর মধ্যেই তার নিকট এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযোগ এসেছিল, সেটির তদন্ত তিনি করছেন। যা এখনো শেষ হয়নি। যেহেতু শিক্ষক পিটিআইয়ে রয়েছেন তাই সেখানে যোগাযোগের পরামর্শ ছিল তার।
এ বিষয়ে প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গাজীপুরের তত্বাবধায়ক(সুপার) রফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত বা এমন ধরনের ঘটনা সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। পলাতক অবস্থায় কিভাবে একজন শিক্ষক প্রশিক্ষনে অংশ নিল এ বিষয়ে তিনি বলেন, চলতি বছর করোনা সংক্রমনের কারনে সকল প্রশিক্ষনার্থীই বাড়ীতে বসে অনলাইনে নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে এ শিক্ষকও রয়েছেন। তবে মামলা সংক্রান্ত তথ্য পেলে তিনি এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন।
গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তিনি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার একটি মামলার কথা শুনেছেন। তবে এর স্বপক্ষে কোন ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। শিক্ষকও নিজে মামলার কথা আমাদের জানাননি। তবে খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ মামলার তদারকি কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক(এসআই) কামরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত শিক্ষক পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পরে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে। সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে তার মামলার বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকেও চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়। তবে পলাতক অবস্থায় তিনি কিভাবে প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিলেন এটা সত্যিই বিস্ময়ের।