ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় ১০ হাজার মানুষের জন্য একমাত্র ক্লিনিকে চিকিৎসার বেহাল দশা
আমজাদ হোসেন শিমুল (রাজশাহী ব্যুরো):
ভারতীয় সিমান্ত ঘেষা ছয়টি পাড়া নিয়ে চর মাঝাড় দিয়াড় গ্রাম গঠিত । এই গ্রামে ছোট-বড় সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষের বসবাস। বিশাল এই জনগোষ্ঠির মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে একটি মাত্র ক্লিনিক। বাংলাদেশের ভু-খ- থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এই এলাকায় নেই রাস্তাঘাট। ইলেকট্রিসিটির আলো পৌঁছায়নি দুর্গম এই এলাকায়। মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠির জন্য একটি মাত্র এই ক্লিনিকে ( চর মাঝাড় দিয়াড় কমিউনিটি ক্লিনিক) নেই চিকিৎসা সেবা। মাত্র একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) থাকলেও দুর্গম ওই এলাকায় যাতায়াতে সমস্যার কারণে তিনি সপ্তাহে ১-২ দিন অফিস করেন। দীর্ঘ ৮ বছরেও ফ্যামেলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্টেন (এফডাব্লুএ) ও হেল্থ অ্যাসিস্টেন (এইচএ) এর পোস্ট ফাঁকা থাকায় এই এলাকার জনগোষ্ঠী মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর- স্বাস্থ্যসেবার থেকে অনেকটা বঞ্চিত। শনিবার (০৪ সেপ্টেম্বর) ওই এলাকার একমাত্র চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিনে গিয়ে চিকিৎসার এমন বেহাল দশার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
শনিবার সরেজমিনে ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেছে- অসহায় মানুষ জ্বর-স্বর্দি, শরীর ব্যথা আর মাথা ব্যথায় ঔষধ নিতে ক্লিনিকে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আর সিএইচসিপি মোছা. সাবিনা সুলতানা এসব ঔষধ বিতরণ করছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেই ঔষধ হাতে নুর ভানু নামে ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক নারী ক্লিনিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। কেমন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন জানতে চাইলে অনেকটা আবেগাপ্লত হয়ে প্রতিবেদককে বললেন, ‘এখানে শুধু জ্বর-স্বর্দির ওষুধ কিংবা প্রসূতি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়া কোনোকিছুই মেলে না। তাও আবার সপ্তাহে ১-২ দিন।’ সপ্তাহে ১-২ দিন কেন জানতে চাইলে বৃদ্ধা এই মহিলা বলেন, ‘দুর্গম এলাকা হওয়ায় আপা (সিএইচসিপি) মাত্র ১-২ দিনই আসেন।’
জোহরা বেওয়া নামের ওই এলাকার বাসিন্দা বলেন, ‘রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। গর্ভবতী কোনো মায়ের হঠাৎ কোনো সমস্যা হলে রাজশাহী শহরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। রাস্তার বেহাল দশা সেই সাথে নদী পাড় হয়ে রাজশাহী শহরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক গর্ভবতী মহিলা ও নবজাতকের জীবন প্রদ্বীপ নিভে যাওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।’ দুর্গম এই এলাকার রাস্তাঘাট সংস্কার ও স্বাস্থ্যসেবার মান দ্রুত উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে- ২০১৩ সালে চর মাঝাড় দিয়াড় কমিউনিটি ক্লিনিকটি স্থাপন করা হয়। প্রথম কিছুদিন এই ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীরা ঠিকমতই আসতো। তবে ক্লিনিকটিতে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতএকমাত্র সিএইচসিপি মোছা. সাবিনা সুলতানা ঠিকমত অফিসে না আসায় সপ্তাহে মাত্র এক/দুই দিন খোলা পাওয়া যায় এই ক্লিনিকটি। ক্লিনিকটিকে গিয়ে দেখা যায়- যত্রতত্র পড়ে আসে জিনিসপত্র। কয়েকটি রুম থাকলেও একটি রুমে গাদাগাদিভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন সিএইচসিপি সাবিনা সুলতানা।
চর মাঝাড়দিয়াড় কমিউনিটি ক্লিনিক সাপোর্ট কমিটির সদস্য মোসা. রিতা খাতুন বলেন, ‘চিকিৎসা ভালই হয়। প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার সিএইচসিপি মোছা. সাবিনা সুলতানা আসেন। তবে তার নদী পারা-পারের কারণে অনেক সমস্যা হয়। এছাড়া রাস্তা ভালো না। তাই তিনি প্রতিদিন আসেন না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্লিনিকের পাশেই ডাক্তারের (চিকিৎসক) থাকার একটি ঘর ছিলো। তবে সেখানে ডাক্তার না থাকায় ঘরটি আর নেই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্লিনিকটিতে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত একমাত্র সিএইচসিপি মোছা. সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘জেলার পবা উপজেলার দারুশা এলাকায় আমার বাড়ি। প্রতিদিন দুর্গম এই এলাকায় এসে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব নয়। তাই সপ্তাহে ২-৩ দিন আসি। তবে এই এলাকার জনগণকে আমার মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। ফোনে কোনো পরারর্শ কেউ চাইলে আমি দিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্লিনিকে আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। দীর্ঘ দিন থেকে ‘ফ্যামেলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্টেন্ট (এফডাব্লুএ) ও হেল্থ অ্যাসিস্টেন্টের (এইচএ) পদ ফাঁকা রয়েছে। তবে শাহানা বেগম নামে স্থানীয় একজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমাকে কাজে সহায়তা করেন।’
কেন স্বেচ্ছা শ্রম দেন এব্যাপারে জানতে চাইলে শাহানা বেগম বলেন, ‘আমি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকেই কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছি। ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার সময় আমাদের ৫ কাঠা জমি মাত্র ৫৪ হাজার টাকায় ক্রয় করে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই আমি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে যাচ্ছি, যদি কখনো আমাকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়- এই আশায়। কিন্তু প্রায় ৮ বছর অতিবাহিত হলেও কেউ আমার জন্য এগিয়ে আসেনি।’
হরিপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের (চর মাঝাড় দিয়াড়) সদস্য মো. শামীম শেখ বলেন, ‘অবহেলিত এই এলাকার রাস্তাঘাটের একেবারে বেহাল দশা। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাটু পর্যন্ত কাদা উঠে যায়। এখানকার মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য রাস্তার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। সেই সাথে একেবারে ভঙ্গুর এই চিকিৎসা মান দ্রুত উন্নয়ন করা এখন সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে।’
এ ব্যাপারে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশি বেশি সেবা দেয়ার কথা। কিন্তু চর মাঝাড় দিয়াড় ক্লিনিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যাপারে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’