গাজীপুরের আমলকি যাচ্ছে বিদেশে, ছোঁয়া লেগেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে
ফয়সাল আহমেদ, (গাজীপুর) :
গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালিগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু গ্রাম থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩ কোটি টাকা সমমূল্যের আমলকি বিক্রি হচ্ছে দেশবিদেশের বাজারে। প্রায় ১২শ মেট্রিক টন আমলকি উৎপন্ন হয় এসব উপজেলায়। আমলকি চাষের জন্য এলাকাগুলি দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হলেও কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে আমলকি চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে এলাকার কৃষকরা। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দারুন ছোঁয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে।
দেশী ও বিদেশী বাজারে অমৃত এই ভেষজ ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাষের জন্য স্বল্প পরিশ্রম, অধিক ফলন এবং সহজেই বাজারজাতকরনের সুবিধা ধাকায় অন্যান্য ফল ও সবজীর পরিবর্তে এখন ব্যাপকভাবে আমলকি চাষ করছেন জেলার কাপাসিয়া উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও কালিগঞ্জের বেশ কিছু গ্রামে। আর বিশেষ প্রক্রিয়া করায় সারা বছর ধরেই আমলকি পাওয়া যাচ্ছে।
এতোদিন বাংলাদেশের আমলকির ভালো বাজার থাকলেও সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারত থেকে থেকে হাইব্রিড জাতের কিছু আমলকি আমদানীর কারনে দেশীয় এ কৃষি পণ্যের বিরাট সম্ভাবনাময় বাজারটিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষক, ব্যাবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা । তারা বিদেশ থেকে আমলকি আনা বন্ধ করে দেশীয় জাতের আমলকি চাষে কৃষকদেরকে সহযোগিতা করার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন।
আমলকি চাষের সাথে জড়িত কৃষক, ব্যাবসায়ি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিগত ৪০ বছর ধরে আমলকি উৎপন্ন হয়ে আসছে । প্রথম অবস্থায় শখের বসে বা নিজেদের চাহিদা পূরন করার জন্য বাড়ীর আশেপাশে এক দুইটিগাছ লাগানো হলেও ক্রমেই এর চাষ বাড়তে থাকে। দেশের বাজারে দেশীয় জাতের আমলকীর ব্যাপক চাহিদা থাকার কারনে বিগত ১০/১২ বছর থেকে কাপাসিয়া উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়ন ও পাশ্ববর্তী কালিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে বাগান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে কাপাসিয়া উপজেলার তিলশুনিয়া, ডেফুলিয়া, ধরপাড়া, কোট বাজালিয়া, চাঁদপুর, জালিশা, হরিদাশপুর, বড়ছিট, ভাকোয়াদী, দুবুরিয়া, কামড়ামাশুক, পাপলা চামুরখী গ্রামে এবং কালিগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া, দুবুরিয়া, জাঙ্গালিয়া, নড়–ন, দেওতলা প্রভৃতি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে বাগান করে আমলকির ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
গত সোমবার সরেজমিনে কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করে কৃষক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য কৃষিপণ্যের চেয়ে আমলকি অনেক উচ্চমূল্যে বিক্রি করা যায় । পুরনো কৃষকদের পাশাপাশি অনেক নতুন তরুন কৃষি উদ্যোক্তাও এগিয়ে আসছেন আমলকি চাষে। বর্তমানে প্রায় ২ হাজারের মত চাষী বাণিজ্যিক চাষের সাথে জড়িত। তাদের কাছ থেকে প্রতি বছর সর্বনি¤œ ৩০ হাজার মন (স্থানীয় চাষীদের হিসেবে) আমলকি দেশে ও বিদেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে । মৌসুমে সর্বনি¤œ ৫০ টাকা কেজি এবং মৌসুম ছাড়া সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা কেজি দরে পাইকারী বিক্রি করা যায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বছর মেয়াদী বাগান কিনে নিয়ে যায়। ফলে বিক্রি করার জন্য কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসব আমলকি কিনে ঢাকার বিভিন্ন আড়ত (শ্যামজাবার, যাত্রাবাড়ী ও কাওরান বাজার) , গাজীপুরে ভোগড়া বাইপাস ও কোনাবাড়ী আড়ত, ঢাকার বিভিন্ন পাইকার, নারায়নগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী ও রপ্তানীকারকদের কাছে বিক্রি করেন । তারা জানান, সবচেয়ে বেশী বিক্রি হয় ঢাকার কয়েকজন রপ্তানীকারকদের কাছে , যারা এসব আমলকি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্Íানী করে থাকেন।
কাপাসিয়া উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের সাবেক ৪নং ওয়ার্ড সদস্য ও আমলকি চাষী মোহাম্মদ আলী জানান, তার বাগানে একশর মত গাছ রয়েছে। এর মধ্যে পুরনো ৪০টা গাছে ফলন আসে। এবছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার টাকার আমলকি বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, আমলকি চাষের আগে তার জমিতে বাঁশ বাগান ছিল, তাতে তেমন কোন আয় হতো না। আমলকি চাষ করে তিনি এখন বেশ ভাল আয় করছেন। তিনি আরো জানান, কলমের চারা লাগানোর এক বছরের মধ্যেই গাছে আমলকি ধরা শুরু করে এবং পরবর্তী বছর থেকে প্রচুর ফলন আসে। গাছ লাগানোর সময় গোবর ও টিএসপি সার এবং শুকনা মৌসুমে সামান্য পানি দিতে হয় । এছাড়া তেমন কোন পরিচর্যা করতে হয় না। বছরে কয়েকবার ফলন সংগ্রহ করা যায় ।
তিলশুনিয়া এলাকার তরুন কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, অন্যান্য কৃষকদের দেখাদেখি তিনি গত বছর পতিত ৬ বিঘা জমিতে আমলকির চারা লাগিয়েছেন। এ বছরই ফল ধরা শুরু করেছে। তিনি জানান, আমলকির বাজার দর অনেক ভাল। চাষ করতেও পরিশ্রম কম লাগে, ফলনও হয় অনেক বেশী। তাছাড়া সরসরি বাগান অগ্রীমও বিক্রি করে দেওয়া যায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেন মোল্লা জানান, তিনি প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আমলকি সরবরাহ করেন। তার নিজের বাগান ও কৃষকদের বাগান বছর মেয়াদী কিনে বিগত ২৬ বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন। তিনি প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কেজি আমলকি বিক্রি করেন।প্রতিদিন ৩ ট্রাক আমলকি ঢাকার আড়তগুলিতে যায়। শুধু গাজীপুরেই বিক্রি হয় ৪০০ কেজি। তিনি জানান, ঢাকার কয়েকজন রপ্তানীকারক রয়েছে, যারা তার কাছ থেকে আমলকি নিয়ে লন্ডন, কানাডা, সৌদি আরব, দুবাই ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করে। গত বছর করোনা মহামারির সময় তিনি সর্বোচ্চ ১৪শ টাকা কেজি দরেও আমলকি বিক্রি করেছেন। তিনি আরো জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বড় আকারের হাইব্রিড আমলকি আমদানী হয়। যখন এগুলো দেশের বাজারে প্রবেশ করে, তখন আমলকির বাজারে ধ্বস নামে। আমরা কেনা দামেও বিক্রি করতে পারিনা। গুনে মানে ভাল না হলেও সস্তায় বিক্রি হয় বলে তখন দেশীয় আমলকির দাম পড়ে যায়। এসব আমদানী বন্ধ না করলে সম্ভাবনাময় দেশীয় কৃষি পণ্যের বিশাল বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। দাম না পেলে কৃষকরা চাষ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তাই, বানিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত এবং হাইব্রিড জাতের এ আমলকি আমদানী বন্ধ করা উচিত।
কাপাসিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরা বলেন, এ এলাকার মাটি ও পরিবেশ আমলকি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। উপজেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে আমলকির চাষ হচ্ছে, যেখান থেকে এছর ১০৮ মে.টন আমলকি উৎপন্ন হয়েছে । উৎপাদিত আমলকির অর্ধেকের চেয়েও বেশী দেশের বাইরে রপ্তানী হয়। তিনি জানান, কৃষকরা আমলকি চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছে । করোনাকালে তারা অনেক বেশী দামে বিক্রি করছে। আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষন প্রদান করছি এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছি। যদি কোন কৃষক সরাসরি বিদেশে রপ্তানী করতে চায়, তাহলে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করবো ।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম(ভারপ্রাপ্ত) বলেন, আমলকি বর্তমানে একটি অর্থকরী ফসল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মধ্যে আমলকির চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছি। সারাবছর ধরে একটি আমলকি গাছ থেকে যাতে ফল পাওয়া যায় এর পরিচর্যার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর ভালো একটি ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমলকি চাষে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা দারুন ছোঁয়া লেগেছে।