খরিপ মৌসুমে ভুট্টার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২৫১ কোটি টাকার
আমজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী) :
ভুট্টা একটি সি-ফোর (সি-৪) প্ল্যান্ট ফসল। আর সি-ফোর জাতীয় শস্য তথা ভুুট্টার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- সূর্যের প্রখর তাপ কিংবা উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও বাম্পার ফলন দিতে পারে। আর তাই বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীতে ভুট্টা চাষে দিন দিন রীতিমত বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। চলতি খরিপ-১ মৌসুমে (১৬ মার্চ-১৫ জুলাই ২০২১) রাজশাহীতে ১০ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন বা ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫৬৮ মণ। হিসাব অনুযায়ী- ৮০০ টাকা মণ হিসেবে রাজশাহীতে এবার আনুমানিক প্রায় ২৫১ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকার ভুট্টার উৎপাদন হবে আশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজশাহীতে যেহারে ভুট্টার চাষ বাড়ছে এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দুর্যোগকালীন খাদ্য ঘাটতি মেটাতে রাজশাহীর উৎপাদিত ভুট্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজশাহীতে প্রায় ১২ মাসেই ভুট্টার উৎপাদন হয়। তবে বছরে দুইবার অর্থাৎ রবি (১৬ অক্টোবর- ১৫ মার্চ) মৌসুম ও খরিপ-১ (১৬ মার্চ-১৫ জুলাই) মৌসুমে ভুট্টার উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। সূত্রমতে, রাজশাহীতে গেল রবি মৌসুম (১৬ অক্টোবর- ১৫ মার্চ ২০২১) অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করে ৯৩ হাজার ৮৭ মেট্রিকটন ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল। সেই হিসেবে উৎপাদিত এই ভুট্টার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৯৯ কোটি ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার ২০০ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজশাহীতে ৮৯১০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করে ৮৬ হাজার ৯৬১ মেট্রিকটন ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আজাদ আলী জানান, চলতি খরিপ-১ মৌসুমে ১০ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে জেলার পুঠিয়া উপজেলায় এবার সবচেয়ে বেশি ভুট্টার চাষ হয়েছে। এই উপজেলায় এবার ২৫০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে বলে তিনি জানান। এছাড়া জেলার পবা উপজেলায় ২৪৪৫ হেক্টর, বাগমারা উপজেলায় ১৮৯০ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ১৩৪০ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ১১৪০ হেক্টর, চারঘাট উপজেলায় ১০০০ হেক্টর, বাঘা উপজেলায় ২২৫ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ৮০ হেক্টর, মহানগরীর মতিহার থানা এলাকায় ১৬ হেক্টর, বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ১৪ হেক্টর এবং জেলার তানোর উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে।
চলতি মৌসুমে ভুট্টা চাষের জন্য আবহাওয়া ও মাটি বেশ উপযোগী হওয়ায় বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখছেন চাষিরা। পুঠিয়া উপজেলার ভুট্টা চাষি আবুল হাসনাত বলেন, ‘ভুট্টার ফলন ধান ও গমের চেয়ে অনেক বেশি। ভুট্টার ফলন হেক্টর প্রতি গড়ে ১১ টন আসে। আর হেক্টর প্রতি ধান থেকে চালের ফলন হয় গড়ে প্রায় ৫ টন। এর কারণটা হচ্ছে ভুট্টার ফলনের পুরোটাই দানা। সেই হিসেবে ধানের চেয়ে ভুট্টার ফলন দ্বিগুণেরও বেশি। একইভাবে গমের ক্ষেত্রেও তাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুঠিয়া এলাকার মাটি ভুট্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগী এবং ফলন অনেক ভালো হয়। তাই এবছর আমি ২ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। আশা করছি- দুই হেক্টর জমি থেকে ১৯-২১ মেটিকটন ভুট্টার উৎপাদন হবে।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি খরিপ-১ মৌসুমে রাজশাহীর হাজার হাজার কৃষক বেশি ফলনশীল ও উন্নতমানের ভুট্টার জাত হিসেবে এনকে-৪০, সানশাইন-৯০০, এস গোল্ড কে-৮২৭ ও প্যাসিফিক-৩৩৯ জাতের ভুট্টার বীজ ব্যবহার করছেন। এবছর মাটি ও আবহাওয়া ভুট্টা চাষের জন্য বেশি উপযোগী হওয়ায় কৃষকরা বাম্পার ফলনের সম্ভাবনাও দেখছে।
রাজশাহীতে ভুট্টার চাষের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ভুট্টা চাষ বৃদ্ধিতে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্যাপকভাবে কাজ করছে। কৃষিতে একটি নিয়ম হলো- যখন কোনো নতুন ফসল কিংবা সম্ভাবনাময়ী ফসলের উদ্ভাবন হয় তখন তার নতুন জাত দিয়ে প্রদর্শণী করা হয়। ভুট্টার চাষে রাজশাহীতে বিপ্লব ঘটানোর জন্য আমরা হাইব্রিড জাতের ভুট্টার প্রদর্শণ রাজশাহীর প্রায় সকল উপজেলায় অব্যাহত রেখেছি। আমাদের সাধারণ প্রকল্পগুলোর সবগুলোতেই এই ভুট্টার প্রদর্শণী রাখা হয়েছে। কারণ, ভুট্টা একটি সি-ফোর প্লান্ট। অর্থাৎ এটি সুর্যের আলো ও তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং এটি চাষেন নির্ষিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। যেকোনো পরিবেশ মানিয়ে নিয়ে ভালো ফলন দেয় ভুট্টা। ভুট্টার ফলন ধান ও গমের চেয়ে অনেক বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভুট্টা রোপনের কোনো মৌসুম নেই। ভুট্টার বীজ গজাতে পারে এমন আবহাওয়া হলেই ভুট্টা রোপন করা যায়। শুধু ডিসেম্বর মাসের শেষ থেকে জানুয়ারির প্রথম অর্থা’ অতিরিক্ত শীতের এক মাস ভুট্টা গজাতে দেরি হতে পারে এই ভেবে ভুট্টা রোপন করা যায় না। কিন্তু বীজ রোপনের অনুকূল পরিবেশ থাকলেই বছরের ৩৬৫ দিনই এই ফসল রোপন করা যায়। ভুট্টার বীজ গজালেই কিন্তু আর কোনো সমস্যা নেই। এজন্য ভুট্টা একটি সম্ভাবনাময়ী ফসল। ভুট্টার আরেকটি গুণ হচ্ছে যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন- এবছর সাত মাস রাজশাহীতে এক ফোটা বৃষ্টিপাত হয়নি। কিন্তু তারপরও ভুট্টার ফলনে কোনো প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ সূর্যের প্রখর তাপ এবং উষ্ণ আবহাওয়া ভ্ট্টুার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এজন্য এই অঞ্চলের চাষিরা ভুট্টা চাষের দিকে বেশি ঝুকছে।’
এই কৃর্ষি কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে ভুট্টার ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। ধানের মত ভুট্টায় কিন্তু সার্বক্ষণিক সেচ লাগে না। ভুট্টা চাষ করতে ৩টি সেচ খুব জরুরি। ৪-৫টি সেব দিলে ভুট্টার বাম্পার ফলন কেউ আটকাতে পারে না। কেননা ভুট্টা খুবই খরাসহিষ্ণু একটি ফসল। আর ভুট্টা কিন্তু সরাসরি মানুষ সরাসরি খুব কমই খায়। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মানুষ এই ভুট্টাই বিভিন্ন মাধ্যমে বেশি খাচ্ছে। কেননা- গরু, মুরগি, হাস কিংবা অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখিকে ফিড আকারে এই ভুট্টাই খাওয়ানো হচ্ছে। কাজেই গরুর খামার কিংবা পল্ট্রি ফ্যাক্টরিতে এই ভুট্টা ব্যাপক আকারে প্রয়োগ হচ্ছে। ভুট্টা না হলে দেশের পল্ট্রি শিল্প কিংবা গবাদি পশু শিল্পের বিকাশ হতো না। তারপরও বাংলাদেশে ভুট্টা স্বয়ংসম্পন্ন না, বাইরে থেকে এই ভুট্টা আমদানি করতে হয়।’
ভুট্টার ভবিষ্যত সাফল্য ও সম্ভাবনা সম্পর্কে এই কৃষিবিদ বলেন, ‘রাজশাহীতে দিন দিন যেহারে ভুট্টার উৎপাদন হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে বাইরে থেকে আর ভুট্টা আমদানি করতে হবে না। দেশের তথা রাজশাহী অঞ্চলের উৎপাদিত ভুট্টা দিয়েই মানুষের জন্য শক্তিবর্ধক বিভিন্ন খাদ্য তৈরী করা সম্ভব হবে। এছাড়া পল্ট্রি শিল্প কিংবা গবাদি পশু শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ সম্ভব ভুট্টার মাধ্যমে তৈরীকৃত ফিডের মাধ্যমে। সবকিছু বিবেচনা করলে অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন দুর্যোগের সময় খাদ্য ঘাটতি মেটাতে এই ভুট্টা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’