সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির অমানবিকতা!
কোর্ট হাজত থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষরের নামে ৫ হাজার টাকা করে আদায়!
এম এ জামান (সাতক্ষীরা):
মোটরযান আইন, পাসপোর্ট আইন, এনআই এ্যাক্ট, প্রকাশ্য জুয়া আইন, নন এফআইআর মামলা, ৩৪ ধারার মামলাসহ জামিনযোগ্য যেকোন ধারার মামলার দরিদ্র আসামীদের জেলে না গিয়ে মুক্তি পাওয়ার সকল আইনী পথ বন্ধ করে দিয়েছে সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতি। এসব ধারায় দায়ের করা মামলার আসামীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর কোর্ট হাজতে থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে না পারায় তাদের জেলে যেতে হচ্ছে। নইলে আইনজীবী সমিতিকে ৫ হাজার টাকা ফিস দিয়ে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে হচ্ছে। এরফলে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে ৫ হাজার টাকা ফিস, ওকালতনামা ক্রয়, কোর্ট ফি, ডেমি বা নির্ধারিত কাগজ ক্রয়, আইনজীবী-মোহরারের ফি ছাড়াও কোর্ট খরচ দিয়ে একজন দিনমজুর দরিদ্র মানুষকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে নি:স্ব হয়ে। আদালতপাড়ার প্রায় সবাই ৫ হাজার টাকা প্রদানের এই অমানবিক আইনের বিরোধীতা করলেও কেউ এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না।
রোববার জামিনে মুক্তি পাওয়া পাটকেলঘাটার পুটিয়াখালি গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম বলেন, তিনি ঢাকার একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন। ১১ মাস পর শনিবার রাত ১০টার দিকে বাড়ি আসার পরপরই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ঈদে পরিবারের সদস্যদের জামা-কাপড় কেনার জন্য কিছু টাকা ছিল তার কাছে। সেই টাকা আইনজীবী সমিতিতে জমা দিতে হলো। এভাবে টাকা নেওয়া আইন সম্মত কিনা প্রশ্ন জিয়ারুলের।
সাতক্ষীরা আদালত সূত্র জানায়, ৫ হাজার টাকা নেওয়ার আইন চালুর পূর্বে কোর্ট হাজতে থেকে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর নেওয়া হতো। সে সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসামীরা প্রতারণার শিকার হতো। থানা ও কোর্ট হাজাতের এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কতিপয় আইনজীবী, মোহরার ও আদালতপাড়ায় টাউট হিসেবে পরিচিত কয়েকজন থানা থেকে আসামী কোর্ট হাজতে আনার পরপরই কোন প্রকার কথাবার্তা ও চুক্তি ছাড়াই ওকালতনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নিতো। তারপর ওই আসামী বা আসামীদেরকে জামিন করানোর নামে তার পরিবারের কাছ থেকে ইচ্ছামত টাকা আদায় করা হতো। এমনকি দাবিকৃত টাকা না দিতে পারলে আসামী জামিন পেলেও তার বেলবন্ডে স্বাক্ষর করা হতো না। এরফলে ঐ আসামী ও তার পরিবারের দুর্গতির শেষ থাকতো না। এহেন পরিস্থিতিতে জেলা আইনজীবী সমিতি কঠোর হয়েও বিচারপ্রার্থীদের এ হয়রানি বন্ধ করতে পারছিলো না। বাধ্য হয়ে গত বছরের মাঝামাঝি নাগাদ সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. এম শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক তোজাম্মেল হোসেন তোজামের নেতৃত্বাধীন কমিটি কোর্ট হাজত থেকে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর গ্রহণ বন্ধ করে দেন।
সেক্ষেত্রে জেলখানা থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করাতে গিয়ে জামিনযোগ্য ধারার আসামীর জেলে না যেয়ে মুক্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাঁচ হাজার টাকা আইনজীবী সমিতির ফান্ডে জমা দিয়ে ওই মানি রিসিট গারদখানায় জমা দিয়ে ওকালতনামায় আসামীর স্বাক্ষর করানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা হলেও ফান্ড বড় হয় আইনজীবী সমিতির। প্রতিবাদ করে বা প্রতিকার চেয়েও লাভ হয়নি বিচারপ্রার্থী ও তাদের মনোনীত আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারিদের। উপরন্তু একই মামলার একই আসামীদের কাছ থেকে পৃথক আবেদনের মাধ্যমে দুই বার টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা জমা নিয়ে গারদখানা থেকে আসামীর ওকালতনামায় স্বাক্ষর করানোর বিষয়টি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে কোন কোন আইনজীবী কোন কোন বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন। এরপরও বিষয়টি অব্যাহত আছে।
সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির কাছে জমাকৃত টাকার রসিদ পর্যালোচনা করে জানা গেছে, গত ১৮ জুলাই শ্যামনগর থানায় দায়েরকৃত র্যাবের উপর হামলা মামলার (জিআর-২১৪/২১ শ্যাম) আসামী রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আল মামুনকে সোমবার দুপুরে আদালতে আনা হয়। ওই দিনই সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এড. আব্দুল মজিদ (২) জেলা আইনজীবী সমিতিতে পাঁচ হাজার টাকা জমা করে তড়িঘড়ি করে গারদ থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করান। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিচারক রাকিব উল ইসলাম বাদির রিমান্ড না’মঞ্জুর করে পুলিশ রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তাকে পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে জামিন দেন। গত কয়েকদিনে এ ধরনের অনেকেই সমিতিতে ৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে জামিন আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন।
জামিন পাওয়া রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন বলেন, এই আইন একজন গরীব বিচারপ্রার্থীর জন্য যথেষ্ট হয়রানিকর বলে তার মনে হয়েছে। একই কথা বলেন, সদর উপজেলার রায়পুরের শাহজুদ্দিন। তিনি বলেন, এটা মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম লঙ্ঘন। আগেও আইনজীবীদের হাতে বিচারপ্রার্থীরা প্রতারিত হয়েছেন। বর্তমানে পাঁচ হাজার টাকা সমিতিতে জমা দিয়ে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। পোয়াবারো শুধু আইনজীবী সমিতির। এ কালা কানুন বন্ধ হওয়া উচিত।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি এড. আব্দুল লতিফ বলেন, আইনজীবী সমিতির এহেন টাকা জমা নেওয়ার বিধান মেনে নেওয়া যায় না। বর্তমান কমিটির উচিত বিষয়টি ভেবে দেখা।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এড. তোজাম্মেল হোসেন তোজাম বলেন, তখনকার পরিস্থিতিতে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বর্তমান কমিটি ইচ্ছা করলে পূর্বের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে।
সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এড. রেজোয়ান উল্লাহ সবুজ বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।
সমিতির বর্তমান সভাপতি এড. আবুল হোসেন (২) বলেন, এড. শাহ আলম ও এড. তোজাম্মেল হোসেন তোজামের সময়ে ওই ধরনের টাকা জমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি বিচারপ্রার্থীদের কাছে কষ্টকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে খুব শিঘ্রই সভা ডেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার প্রস্তাব রাখা হবে।