মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে
কক্সবাজার জেলার অধীন মহেশখালী উপজেলা অতীত কাল থেকে একটি সমৃদ্ধিশালী এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। কক্সবাজার জেলা থেকে এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। আদিকাল থেকেই মহেশখালীতে লবণ, শুঁটকি, চিংড়িমাছ ও মিষ্টি পান উৎপন্ন হয়ে আসছে। দেশের সিংহভাগ লবণ মহেশখালী থেকে যায়। মিষ্টিপানের জন্য মহেশখালীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।
মহেশখালীতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় ১২০০ মে.ও. কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ উত্পাদনকেন্দ্র সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে জ্বালানি হিসেবে কয়লা তুলনামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের হওয়ার কারণে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সম্পূর্ণ সরকারের মালিকানাধীন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১১ সালে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) গঠন করা হয়। লক্ষ্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনকে প্রাধান্য দিয়ে জাপান সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসপি) প্রণয়ন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিপিজিসিবিএল সর্বাধুনিক আলটা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে সিপিজিসিবিএল বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উত্পাদনের নীতিমালা অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথবা সরকারের অন্য কোন নীতিমালা অনুসরণ করত বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করবে।
বর্তমানে সিপিজিসিবিএল এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। এ প্রকল্পের আওতায় আমদানিকৃত কয়লা লোড-আনলোড জেটি, বিদ্যুৎ উত্পাদনকেন্দ্র, টাউনশিপ নির্মাণ, স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুতায়ন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যুেকন্দ্রের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। উক্ত প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন/ সমীক্ষা (ইআইএমএ) এবং সাম্ভাব্যতা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সম্পাদন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং জাইকার মধ্যে ২০১৪ সালের ১৬ জুন একটি ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (জিডিপি) অনুযায়ী এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট অর্থায়নের ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা থেকে এবং অবশিষ্ট ৭ হাজার ৪৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ দক্ষ জনবল তৈরি হবে।
কয়লা লোড-আনলোডের জন্য বন্দর সহ মাতাবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের নিমিত্ত ১৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালে Owoner's Engineries হিসেবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমজেভিসি-কে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশনের কনসোর্টিয়ামকে মাতাবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে ২০১৭ সালে নিয়োগ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিদুেকন্দ্র ও বন্দর নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো মেসার্স পেন্টা-ওশান কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে প্রদান করা হয়েছে। বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণকালীন সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও স্থানীয় গ্রামীণ জনপদের বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে চকরিয়া-মাতাবাড়ি ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও মাতাবাড়ি ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট থেকে ইপিসি ঠিকাদার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি মাতাবাড়ি ১২৬০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।
বর্তমানে ইপিসি ঠিকাদারদের চ্যানেল ড্রেজিং, পাওয়ার বণ্টক ও কোল ইয়ার্ডের ভূমি উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য বিসেটেলমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য এনজিও নিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ৬৪৯ জন জমির মালিককে এককালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৪.২৮৮ টাকা এবং ভূমিহারা ৯৬ জন তাদের জমির অতিরিক্ত মূল্য হিসেবে ৯.৯৩৮ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ভূমিহীন পরিবার ও পানি উন্নয়ন বাঁধের ওপর বসবাসকারী বাস্তুহারা পরিবারের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। মাতাবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। মহেশখালীতে সরকার যেসব উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আমরা আশা করি, মহেশখালীর এই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশালসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়ে যাবে।