কভিডকালের চেয়েও নিচে নেমে গেছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি
 
                                                                                                ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্প অধ্যুষিত এলাকার একটি পাদুকা কারখানার ইউনিট সম্প্রতি বন্ধ (লে-অফ) ঘোষণা করা হয়েছে। গত প্রায় দেড় বছর পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ও রফতানি বাজারের অন্যতম বৃহৎ এ কারখানাটির উদ্যোক্তা। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল হারে বাড়তে থাকায় কারখানার একটি ইউনিট সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কারখানার ইউনিট বন্ধ করার মতো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ পুঁজিঘন বস্ত্র শিল্পের সুতা ও কাপড়ের কিছু কারখানাও। বস্ত্র ও পাদুকা ছাড়া অন্য উৎপাদন খাতের শিল্প-কারখানার পরিস্থিতিও নাজুক বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগ করার মতো পরিবেশ কিংবা সক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। বিনিয়োগ খরার কারণে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন, দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। এমনকি কভিডকালের চেয়েও এ সময়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বছর পাঁচেক আগে কভিড মহামারীকালে লকডাউনের কারণে পুরো বিশ্ব একরকম থমকে গিয়েছিল। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সবকিছুই বন্ধ ছিল সে সময়। বৈশ্বিক মহামারীর সে বছর বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দশমিক ২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। অন্যদিকে কভিডকালে কর্মযজ্ঞ থেমে যাওয়ার মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুদের হার বৃদ্ধি, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বমুখিতা এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বর্তমানে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছেন না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে যায়। কভিডের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ২ শতাংশ। তবে লকডাউন তুলে নেয়ার পর অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করলে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এর পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি আরো বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস নামে। সে অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর পরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে মাত্র দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরটি যেমন গেছে তাতে আমাদের মনে হচ্ছিল যে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে। সেক্ষেত্রে সামান্য হলেও তো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে যে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে ছিল ও আছে। যদি ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে তাহলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে সামনের অর্থবছরে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে জ্বালানির ঘাটতি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন সরকার এসে যদি জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারে এবং আর্থিক খাতের অবনতি না হয় তাহলে সামনের অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
দেশের বস্ত্র খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ খাতের কিছু কারখানা আগে দৈনিক তিনটি শিফটে উৎপাদন পরিচালনা করত। কিন্তু এখন সেগুলোতে চলছে দুই শিফট। আবার কেউ কেউ মাত্র একটি ইউনিট চালু রেখে কারখানা সচল রেখেছেন। কিছু কারখানার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে এ ধরনের পরিস্থিতিতে থাকা কারখানার সংখ্যা ২০ থেকে ২২টি। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রড-সিমেন্টের কারখানাগুলো ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশের বেশি সক্ষমতায় চলতে পারছে না। কারণ চাহিদা নেই। সরকারের কাজ বন্ধ, আবার আবাসনেও কিছু হচ্ছে না। ছোট ছোট অনেক শিল্প বসে গেছে। গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। বাজারে চাহিদা নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এখন রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করতে যাচ্ছে না, কাপড় কেনা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোমল পানীয়ের শিল্প বন্ধ হওয়ার তথ্য শুনতে পাচ্ছি। টেক্সটাইল শিল্পের কারখানাও বন্ধ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। অনেকে কম সক্ষমতায় কারখানা সচল রেখেছেন।’
শিল্প ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আরো বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির খারাপ অবস্থার কারণে মানুষ ঘরের বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ রয়েছে এমন বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান জানিয়েছে গ্যাসের অভাবে কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। কেউ এখন সম্প্রসারণের কথা ভাবতে পারছেন না। সরকার কারো কোনো কথা শুনছে না। কোনো ব্যবসায়ীর সমস্যা শুনতে সরকার আগ্রহী না। এ রুগ্ণ পরিস্থিতি আরো তীব্র হবে। সবাই এখন শুধু টিকে থাকতে চাচ্ছে। নির্বাচন ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া এ অস্বস্তির পরিবেশ থেকে বের হওয়া কঠিন হবে।’
বস্ত্র ও পাদুকা খাতের মতো প্রায় একই অবস্থা অন্য উৎপাদন খাতের কারখানায়ও। অধিকাংশ কারখানা বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের বেশি সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। রড-সিমেন্ট থেকে শুরু করে কোমল পানীয় কারখানা পর্যায়ক্রমে রুগ্ণ হতে শুরু করেছে।
সিমেন্ট শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান সিমেন্ট কারখানাগুলো সক্ষমতার মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছে, যা শিল্পের পূর্ণ সম্ভাবনার তুলনায় অত্যন্ত কম। এর মূল কারণ হিসেবে তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার অস্থিরতার কথা বলছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সরবরাহ শৃঙ্খলায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে সিমেন্ট খাতে নতুন করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনও বর্তমানে নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে সিমেন্টের উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। সরকারিভাবে প্রজেক্ট নেই, নতুনভাবে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে না। আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। এসবই মূল কারণ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মূল্যায়নেও দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার চিত্র উঠে আসছে। তবে একটা সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে এ স্থবিরতা কাটতে শুরু করবে।’
অদূর ভবিষ্যতে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতির গতি শ্লথ থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রকাশিত ‘মাসিক সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শিল্প ও পরিষেবা খাতে মন্দার কারণে বছরের শেষ প্রান্তিকে তা ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে যায়। ফলে গত অর্থবছরে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে। মূলত দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশ, রফতানি প্রবৃদ্ধির স্থবিরতা ও বিনিয়োগ না আসার কারণেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ দশা। এতে আরো বলা হয়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২৩ বছর পর গত আগস্টে সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে আসে। উচ্চ সুদহার, কঠোর মুদ্রানীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সময় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনা গেছে। তবে মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে পিছিয়ে থাকায় প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে।
নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে না ওঠায় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। এক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প খাতের মৌলিক তিনটি উপকরণের (মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল) আমদানি এলসি খোলার প্রবণতা নিম্নমুখী। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি এলসি ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ দশমিক ১৫ শতাংশ কমেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে বিনিয়োগ খরা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ার প্রভাব রয়েছে।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মূলধনের অন্যতম উৎস হচ্ছে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগ খরার কারণে পুঁজিবাজার থেকেও মূলধন সংগ্রহে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। গত এক বছরে উৎপাদন খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র ১২টি কোম্পানি ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রায় ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এক বছরে এত কমসংখ্যক কোম্পানির কাছ থেকে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা এর আগে কখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও এখন কভিডের সময়ের তুলনায় কম। চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনে দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। আর জুলাই ও আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি প্রবৃদ্ধি নয়, বরং ঋণাত্মক ধারায় চলে যায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আগস্টে এসে এ ঋণ স্থিতি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ঋণ স্থিতিতে প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংকোচনমুখিতার অংশ হিসেবে গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষে সে লক্ষ্যের ধারে-কাছেও যেতে পারেনি দেশের ব্যাংক খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে এনে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আগস্ট শেষে এ লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি অর্থবছরের একই মাস পর্যন্ত এক বছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের বিরাজমান ঋণ প্রবৃদ্ধিকে ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন বলে আখ্যায়িত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সরকারের এ বিভাগের সেপ্টেম্বরের ‘ইকোনমিক আপডেট অ্যান্ড আউটলুক’-এ বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থাকা এ প্রবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ, উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকগুলোর সতর্ক ঋণনীতির প্রতিফলন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট)। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এ নীতি সুদহার এখনো বহাল রয়েছে। নগদ টাকার (তারল্য) সংকট ও নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুন থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখনো মূল্যস্ফীতির হার উসকে উঠতে দেখা গেছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো সে অর্থে নতুন কোনো ঋণই বিতরণ করছে না। বার্ষিক ভিত্তিতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেটিও অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব থেকে এসেছে। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে এতটা খরা এর আগে দেখা যায়নি। যদিও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। পণ্য উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের বড় অংশ বেসরকারি উদ্যোগনির্ভর। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব না হলে দেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না।
ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিচ্ছে না, অন্যদিকে উদ্যোক্তারাও নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যাংকে ঋণ শুরু হয় আমদানির এলসি খোলা থেকে। গত দুই বছর আমদানি পরিস্থিতি ভালো নেই। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ব্যাংকগুলো সে অর্থে নতুন কোনো ঋণই দিচ্ছে না। ব্যাংকাররা এখন ঋণ না দিয়ে সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছেন। এ কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, ‘গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতে যে উচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সেটিও অস্বাভাবিক। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেয়া হয়েছে। যে ১১-১২টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঋণ বের হতো, সেগুলো এখন পঙ্গু। পাঁচটি ব্যাংক এখন একীভূত হওয়ার পথে। এ ব্যাংকগুলোর ১ টাকা ঋণ দেয়ার সক্ষমতাও নেই।’


 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                            
 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                 
                                                                                