South east bank ad

আমদানিসহ নানা উদ্যোগেও কমছে না চালের দাম

 প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   আমদানী/রপ্তানী

আমদানিসহ নানা উদ্যোগেও কমছে না চালের দাম

দেশের বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালের শুল্ক প্রত্যাহার, টাস্কফোর্স গঠন, আমদানির অনুমোদন, কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়াসহ সরকারের নানা উদ্যোগেও ভোক্তার স্বস্তি মিলছে না। চালের বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি এবং ভারতসহ উজানের দেশগুলো থেকে আসা ঢলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে।

একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে চালের দাম দেশের বাজারের তুলনায় বেশি। এসব কারণে গত ১৫ দিনে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

সম্প্রতি দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম সহনীয় রাখতে চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে সরকার। ফলে ১৯ মাস পর দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হয়েছে।

এরইমধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হলেও কমছে না চালের দাম। এদিকে ভারতও চালের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। তাতেও আমদানিতে আগ্রহী নন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল যদি আমদানি করা হয়, তবে বর্তমানে দেশের বাজারের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে ক্রেতাদের কিনতে হবে। শুল্ক কমানো হলেও এ মুহূর্তে দেশে চালের দামে প্রভাব পড়বে না। আর যে চাল আমদানি করা হয়েছে, তাও বাজারে আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে না। শুল্ক কমানোর পর এর সুবিধা একটি পক্ষ নিয়ে নিচ্ছে, ভোক্তারা পাচ্ছেন না। সরকারের নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে, তদারকি আরও বাড়াতে হবে।

তারা বলছেন, সরকার এখন শুধু খুচরা পর্যায়ে তদারকি করছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদক, করপোরেট, মিল, পাইকারি ও খুচরা— সব স্তরেই তদারকি করতে হবে, যা হচ্ছে না।

তারা আরও বলছেন, যেভাবেই হোক, বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকার বাজার সংস্কারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না নেওয়ায় শৃঙ্খলা ফিরছে না। বাজার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ তাদের।

মঙ্গলবার রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চালের দাম কমেনি। অথচ চালের দাম কমাতে গত অক্টোবরে দুদফায় শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে দুই শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপরও কমেনি।

খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে চিকন চাল দেশি বাসমতির কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৭২ থেকে ৮২ টাকা, মিনিকেট চাল ৬৮ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের বি আর ২৮, ২৯ নম্বর চাল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা এবং গুটি, স্বর্ণা, চায়না ইরিসহ মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকায়।

সূত্রাপুর বাজারের মেসার্স আদনান অ্যান্ড আরাফাত ট্রেডার্সের মালিক মো. ফারুক  বলেন, আমদানির চাল এখনো বাজারে আসেনি। চাল ঢুকলে দাম কমতে পারে। চালের বাজার একটু দেখছি। ভারতে থেকে চাল এনে লাভ করতে পারব না। কারণ সেদেশেই চালের দাম বেশি, ডলার রেট ও পরিবহন খরচও বেশি। তাই আমাদের বাজারে দাম কমার সুযোগ কম।

এদিকে পাইকারি বাজারে বর্তমানে চিকন চাল প্রতি কেজি দেশি বাসমতি চাল প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৮৮ টাকা। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৮ টাকায়। মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।

মাঝারি মানের বি আরের কেজি ২৮ চাল ৬০ টাকা। বি আর ২৯ চালের কেজি ৫৮ টাকা। পাইজামের কেজি ৫৭ থেকে ৬১ টাকা। মোটা চাল গুটি স্বর্ণা মানভেদে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড ধানের চাল (গুটি) বা সব চেয়ে মোটা চালের কেজি ৪৯ টাকা।

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন চালের দাম সাত থেকে ১০ শতাংশ বেশি। এক মাসে বেড়েছে দুই শতাংশ পর্যন্ত। বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা।

মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৮০ টাকায়। এ ছাড়া গত সপ্তাহে মাঝারি মানের চালের দাম বেড়ে যায় প্রায় এক শতাংশ। গত মাসে বাড়ে প্রায় দুই শতাংশ।

বার্ষিক হিসাবে চিকন চালের দাম বেড়েছে নয় দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মোটা চালের দাম বেড়েছে সাত দশমিক ১৪ শতাংশ।

এদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বৈরী আবহাওয়ার কারণে চাল উৎপাদন ব্যাহত হয়। পর্যাপ্ত সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল রপ্তানিতে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ এবং কোনো কোনো মানের চালের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটির সরকার।

তবে গত ২৩ অক্টোবর ভারত সরকার টনপ্রতি ন্যূনতম রপ্তানি দাম ৪৯০ ডলার তুলে দিয়ে বাসমতি ছাড়া অন্য চালের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। ভারত সেদ্ধ চালের ওপর ১০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক তুলে নেওয়ার একদিন পর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমাতে সহায়তা করতে পারে। তবে স্থানীয় আমদানিকারকেরা বর্তমান দাম বিবেচনায় আমদানির কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

মেসার্স রশিদ রাইস এজেন্সির মালিক বলেন, বর্তমানে বাজারে চালের সরবরাহ কম। সরবরাহ বাড়লে দাম এমনিতেই কমে যাবে। কয়েকদিন পর আমন উঠবে। তখন মোটা চালের দাম কমবে। আর সরকার চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমদানির চাল বাজারে আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে আমদানি করা চালের দাম দেশি চালের চেয়ে বেশি হলেও তা মানুষ খাবে। কারণ চালের মান ভালো। যারা ভালোটা খান, তাদের কাছে দাম কোনো বিষয় নয়। আমরা আশা করছি, চালের দাম শিগগিরই কমে যাবে।

বাবুবাজারের চালের আড়ত মেসার্স ফেমাস রাইস এজেন্সির বিক্রয়কর্মী মো. সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ভারতে চালের দাম বেশি। মিনিকেট আনলে দাম পড়বে ৭৪ টাকা। আর দেশি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকায়। চিকন চাল এনে লাভ হবে না।

তিনি বলেন, মোটা চাল আনলে দাম একটু কমবে। আমনের মোটা চাল উঠলে দাম কমবে। চিকন চাল বৈশাখ মাসের আগে আসবে না। তার আগে আর চালের দামও কমবে না।

হাজী রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন বলেন, গত ১৫ দিনে মোটা চিকন সব ধরনের চালে দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। চাল আমদানি হয়েছে শুনেছি। কিন্তু বাজারে এখনও আসেনি। মনে হয় না তেমন কোনো লাভ হবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বেশি।

তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষে বাজারে নতুন আমন চাল এলে মোটা চালের দাম একটু কমবে। আর এ সময়ের মধ্যে আমদানি করা চালও বাজারে আসবে। মোটামুটি বলা যায়, ডিসেম্বর থেকে চালের দাম কমে যাবে।

গত অক্টোবরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এর আগে বলা হয়েছিল, চাল আমদানি বাড়াতে শুল্ক-কর পুরোপুরি তুলে নেওয়া দরকার। চাল সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল পণ্য। গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় চালের পেছনে।

ওই প্রতিবেদনে বিশ্ববাজারের একটি চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছর আগের তুলনায় এখন চালের দাম ১১ শতাংশ কম। গত এক মাসে তা ৪ থেকে ৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু তারপরও আমদানি করতে গেলে খরচ অনেক পড়বে।

কমিশন বলেছিল, থাইল্যান্ডের চালের দাম পড়বে ৬৬ টাকা কেজি। এর সঙ্গে শুল্ক-কর ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে দেশে দাম পড়বে ৯২ থেকে ৯৫ টাকা। ভারত থেকে আমদানি করতে গেলে প্রতি কেজির দাম পড়বে ৫৪ টাকা। এর সঙ্গে শুল্ক-কর ও অন্যান্য খরচ যোগ করে দাম পড়বে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। ট্যারিফ কমিশনের মত ছিল, এ দামে চাল আমদানি কঠিন। তাই শুল্ক-কর তুলে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

BBS cable ad