তৈরি পোশাক খাতে আগামীর চ্যালেঞ্জ

তাজরিনের আগুন আর রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের কারখানার শ্রম পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এই ঘটনার রেশ ধরেই বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পায় না বাংলাদেশ। কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার উন্নয়নে দেয়া হয় ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর পরিদর্শনে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাজোট গঠন করে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। প্রাথমিক পরিদর্শন শেষে ভবনের সংস্কার, আগুন ও বিদ্যুত্ নিরাপত্তার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। শুরু হয় সংস্কার কার্যক্রম। কারখানা স্থানান্তর আর সংস্কারে প্রয়োজন ২ বিলিয়ন বা ২শ’ কোটি ডলার।
সংস্কারে অর্থায়ন এখন কারখানা মালিকদের বড় চিন্তা। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স ঋণ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) মাধ্যমে কিছু অর্থ সহায়তা দিতে যাচ্ছে। তবে কারখানা মালিকরা বলছেন, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে ওই অর্থ পাওয়ার ঝক্কিও কম না। বড় কারখানা মালিকরা দ্রুত সংস্কারে হাত দিলেও সংকটে আছে ছোট ছোট কারখানা। যে মানের সংস্কার প্রয়োজন তার জন্য এসব কারাখানা মালিকদের নেই আর্থিক সক্ষমতা। অন্যদিকে, সংস্কার করতে না পারলে ক্রেতা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এমন বাস্তবতায় পথ একটিই, বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হওয়া। বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আসছে দিনগুলোতে এখানেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে তৈরি পোশাক খাত।
চীনকে অর্থনৈতিকভাবে পিছনে ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্যিক জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি। বাণিজ্যের নতুন এই মেরুকরণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামাতে পারে। নতুন এই চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ ১২টি দেশ নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বাণিজ্য করতে পারবে। এদের অন্যতম ভিয়েতনাম। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই বাজারে বাংলাদেশ গড়ে শুল্ক দেয় ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যেখানে ভিয়েতনাম দেয় ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। টিপিপি চুক্তি কার্যকর হলে ভিয়েতনাম বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে আগের মতই রপ্তানিতে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মত নতুন সম্ভাবনার বাজারও হাতছাড়া হতে পারে। পরের চ্যালেঞ্জটা হতে পারে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হারানো। একদিকে সংস্কারের চাপ, অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির তাগিদ, তাই বাড়ছে খরচ। খরচ কমাতে বড় কারখানা মালিকরা ঝুঁকছেন পোশাক তৈরির অত্যাধুনিক মেশিনে। প্রযুক্তিনির্ভর এসব মেশিন পরিচালনা করতে পারবে না অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিকরা। অন্যদিকে ধীরে ধীরে উন্নত পোশাক তৈরির দিকে যাচ্ছেন তৈরি পোশাক শিল্প-মালিকরা। এজন্যও প্রয়োজন অত্যাধুনিক মেশিন। এই দু’য়ের ফলাফলে প্রযুক্তির ব্যবহারে কমে আসবে শ্রমিকের চাহিদা। আশঙ্কা রয়েছে বহু শ্রমিকের বেকার হওয়ার। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তবে অত্যাধুনিক মেশিনের ব্যবহার বাড়লে চাহিদা বাড়বে দক্ষ শ্রমিকের।
তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জের আশংকা দেখা যাচ্ছে। শ্রমশক্তির ঘাটতি না থাকলেও ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বেশি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, জমির সংকট আর জ্বালানি সমস্যার কারণে বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তা এখন বিদেশের মাটিতে তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। সহজে জমি প্রাপ্তি, সরকারের আগ্রহ আর শ্রমিকের বেতন কম হওয়ায় ভারতসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ করতে চায় উদ্যোক্তারা।
বাস্তবতা হচ্ছে দেশে এমনিতেই চাহিদার তুলনায় স্থানীয় বিনিয়োগ কম। এসব চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় নিয়ে এখন থেকেই গার্মেন্টস খাতে নজর দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। সংস্কার কাজে সহজশর্তে ঋণ প্রদান, শিল্প প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক আইন প্রণয়ন, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ এসেছে। অন্যদিকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের উপর জোর দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন বাজার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে।