ওস্তাদ বারীণ মজুমদার এর জন্মদিন আজ

শুধু আগ্রা ও রঙ্গিলা ঘরানার যোগ্য উত্তরসাধকই নন, উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ বারীণ মজুমদার। এ সঙ্গীত অধ্যক্ষ, রাগসঙ্গীত বিশারদ ও শিল্পী ২০০১ সালের এ দিনে (৩ অক্টোবর) ঢাকায় মারা যান। তিনি ‘সঙ্গীত কলি’ ও ‘সুর লহরী’ নামে দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন।
বারীণ মজুমদার ১৯১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাবনার রাধানগরের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার ও মা মণিমালা মজুমদার। পারিবারিক পরিমণ্ডলে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হলেও ১৯৩৮ সালে কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে রীতি অনুযায়ী সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। ছেলের সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে নিশেন্দ্রনাথ লক্ষ্ণৌ থেকে ওস্তাদ রঘুনন্দন গোস্বামীকে নিয়ে আসেন এবং বারীণ মজুমদারের ওস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ১৯৩৯ সালে লক্ষ্ণৌর মরিস ‘কলেজ অব মিউজিক’ এ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন এবং বি মিউজ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে ওই কলেজ থেকে ‘সঙ্গীত বিশারদ’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ইতোমধ্যে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, অধ্যাপক জে এন নাটু, ওস্তাদ হামিদ হোসেন খাঁ প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নেন। পরে স্বতন্ত্রভাবে ওস্তাদ খুরশীদ আলী খাঁ, চিন্ময় লাহিড়ী, আফতাব-এ-ম্যুসিকী ও ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর কাছ থেকে তালিম নেন।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বারীণ মজুমদার পাবনায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালের জমিদারী হুকুম দখল আইনে ১৮ বিঘার জমির ওপর নির্মিত তাদের বসতভিটাসহ সব সম্পত্তি সরকারি দখলে চলে যায়। এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। ওই বছরেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এ সময়েই সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মনোনিবেশ করেন এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গীত বিষয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করেন। ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত রাগসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ওই বছর বুলবুল একাডেমীর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন ও ‘প্রথাসিদ্ধ ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চা’ কোর্স চালু করেন।
১৯৬৩ সালের ১০ নভেম্বর বারীণ মজুমদার ঢাকার কাকরাইলে একটি বাসায় মাত্র ৮৭ টাকা, ১৬ শিক্ষক ও ১১ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে দেশের প্রথম সঙ্গীত কলেজ ‘কলেজ অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস তৈরি করে ওই কলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজে পরিণত করেন এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক পরীক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ সাল থেকে বারীণ মজুমদার নিয়মিত ঢাকা টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী হিসেবে রাগসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারের অডিশন ও গ্রেডেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে ‘মণিহার সঙ্গীত একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে সঙ্গীতের পাঠ্যপুস্তক ‘সঙ্গীতকলি’ ও 'সুর লহরী' প্রণয়ন করেন।
১৯৭০ সালে তিনি সঙ্গীত কলেজের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সম্মেলনে নাজকোত-সালামত, আমানত-ফতেহ, মেহেদী হাসান, আসাদ আলী খাঁসহ বহু গুণী শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠ ও যন্ত্র শিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলন’ আয়োজন করেন। ১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশনের অধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে’ গান পরিবেশন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ‘সুর সপ্তক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮৬ সালে লক্ষ্ণৌর ‘মরিস কলেজ অব মিউজিক’ পরিদর্শনে যান। ওই বছরের ১৪ মার্চ তার প্রতিষ্ঠিত ‘মনিহার সঙ্গীত একাডেমী’ উদ্বোধন করেন পণ্ডিত যশরাজ। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন পণ্ডিত ভি জি যোগ। ১৯৯১ সালের জুন মাসে শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য বারীণ মজুমদার অনেক সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে তাকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের বেসামরিক খেতাব ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে একুশে পদক ও বরেন্দ্র একাডেমীর সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার ও ১৯৯০ সালে সিধু ভাই স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমী তাকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৯৩ সালের জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ রবীন্দ্র পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালে বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ তাকে ‘শিল্পী শ্রেষ্ঠ’ খেতাব দেয়। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ পান। ১৯৯৮ সালে জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা পদক লাভ করেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে।
ওস্তাদ বারীণ মজুমদারের স্ত্রী প্রয়াত ইলা মজুমদারও একজন বরেণ্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। তার বড় ছেলে পার্থ মজুমদার একজন সঙ্গীত পরিচালক, ছোট ছেলে বাপ্পা মজুমদার দেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক।