গফরগাঁওয়ে ঈশা খাঁর বীরত্বের ৪০০ বছরের ইতিহাস মুছে দিচ্ছে দখলদার
এইচ কবীর টিটো, গফরগাঁও
গিয়াসুদ্দিন মামুদ শাহের রাজত্বের শেষভাগে,১৫৩৬ সালের কাছাকাছি সময়ে ঈশা খাঁর জন্ম হয়। গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর সলিমান খাঁ নিজেকে সুলতানের বৈধ উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। সেই সময় দিল্লিতে পাঠান শের শা শূরী তখ্ত্ দখল করেছেন। সলিমান খাঁ পাঠানদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। বাংলার পাঠান শাসক ইসলাম শাহ শূরীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি নিহত হলেন। তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈশা খাঁ আর ইসমাইল খাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে তুরানে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ইসলাম শাহর মৃত্যুর পর বাংলায় কারনানী বংশের শাসন শুরু হয়। তাজ খাঁ কারনানী বাংলার শাসক হলে ঈশা খাঁর মামা (অনেকের মতে তাঁর কাকা)তাঁর অধীনে চাকরি নেন। সুলতানের রাজদপ্তরে থাকার সুবাদে সুযোগ বুঝে খোঁজখবর করে দুই ভাগ্নে-ঈশা খাঁ আর ইসমাইল খাঁকে তুরান থেকে বাংলায় ফিরিয়ে আনেন।
এর পর থেকে শুরু হয় ঈশা খাঁ অন্য এক জীবন।তাকে প্রতিশোধ নেয়ার দীক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হয়।ঈশা খাঁ হয়ে উঠেন ন্যায়পরায়ণ শাসক,যোদ্ধা।
মোঘল আমলে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ঈশা খাঁর বীরত্ব ৪০০ বছর ধরেই মুখে মুখে। মোঘল সেনানায়ক মানসিংকে লড়াইয়ে হারিয়ে তিনি অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন বাংলার স্বাধীনতা। এই লড়াই যেখানে সংগঠিত হয়েছিল সেটি ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার টাঙ্গাব গ্রামে।
স্থানটি শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত । নদীর পূর্ব তীরে ছিল রাজা মানসিংয়ের রাজধানী টোক নগরী (বর্তমানে কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর পূর্বাংশ)। মানসিং ১৫৯৫ সালে রাজস্থান থেকে তার রাজধানী টোক নগরীতে স্থানান্তর করে নিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে ছিল টাঙ্গাব গ্রাম ও টোক নগর। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ঈসা খাঁর বিখ্যাত দুর্গ এগারসিন্দুর। এটি পড়েছে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
ইতিহাসের পাতা অনুযায়ী গফরগাঁওয়ের টাঙ্গাব গ্রামে ঈশা খাঁ-মানসিংয়ের যুদ্ধ হয়েছে ৪২০ বছর আগে। এ সময়টুকুর মধ্যে রাজনৈতিক অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। কিন্তু এ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আজও কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। যা হয়েছে তা হলো ঐতিহাসিক যুদ্ধের এই ময়দান দখলে ভূমি খেকোদের মহোৎসব। "৫২"র ভাষা আন্দোলনে ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালে গড়ে তোলা হয় সেখানে একটি শহীদ মিনার।বিগত ৫০ বছরে এর আশেপাশের সব জায়গা দখলের কারণে শুধু শহীদ বেদী টুকু নিয়ে মিনারটি যুগ যুগের সাক্ষী হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের প্রায় ১৬ একর খাসজমির একাংশ বেদখল হয়ে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। বাকি অংশে ফসল চাষ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কিছু উৎসাহী মানুষ ছোট্ট একটি স্মৃৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে স্মৃতির পাতায় একটু হলেও আঁচড় কাটতে সক্ষম হলেও তা আজ দখলদারিত্বের কারণে সেটিও উপড়ে ফেলা হয়েছে।
যুদ্ধের বিবরণে প্রকাশ ঈশা খাঁর অনুপস্থিতিতে মানসিং আক্রমণ করেন ঈশা খাঁর দুর্গ এগারসিন্ধুর। সংবাদ পেয়ে ঈশা খাঁ দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন। কিন্তু তার সৈন্যরা এতই ক্লান্ত ছিল যে, তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ঈশা খাঁ মানসিংকে একক যুদ্ধের আহ্বান জানান।
ওই লড়াইয়ের আগে ঠিক হয়, যিনি যুদ্ধে জয়ী হবেন তিনিই বাংলার কর্তৃত্ব লাভ করবেন। মানসিং এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে শুরু হয় লড়াই।
প্রথম দিনের লড়াইয়ে মানসিং নিজে না এসে অজ্ঞাতনামা এক যুবককে পাঠান। যুবক ছিলেন মানসিংয়ের জামাতা। ঈশা খাঁ তাকে চিনতে পারেন এবং যুদ্ধে যুবকটির মৃত্যু হয়। ঈশা খাঁ এরপর মানসিংকে তার ধিক্কার দিয়ে ফিরে আসেন। এতে মানসিং নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং ঈশা খাঁর সঙ্গে তুমুল লড়াই হয়। একপর্যায়ে মানসিংয়ের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ তাকে আঘাত না করে নিজের তরবারি মানসিংকে দেন। কিন্তু মানসিং তরবারি না নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন।
ঈশা খাঁ তখন মানসিংকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। কিন্তু মানসিং তা গ্রহণ না করে ঈশা খাঁকে আলিঙ্গন করেন। তার সাহস ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
মানসিং শিবিরে ফিরে গেলে তার রানি তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, মোঘল সম্রাট আকবর এই ঘটনায় মানসিংকে হত্যা করবেন এবং তিনি বিধবা হয়ে যাবেন।
এরপর ঈশা খাঁ নিজেই এই সমস্যা সমাধান করেন। তিনি মানসিংয়ের সঙ্গে সম্রাট আকবরের দরবারে যেতে রাজি হন। সেখানে গেলে ঈশা খাঁকে বন্দি করেন সম্রাট। পরে মানসিংয়ের কাছে সব কথা শুনে তিনি ঈশা খাঁকে ২২ পরগনায় আধিপত্য ও মসনদ-ই আলী উপাধিতে ভূষিত করে স্বদেশে ফেরত পাঠান।
এই ২২ পরগনার একটি ভাওয়ালবাজু। এর অংশ তপ্পারন ভাওয়াল। এই এলাকায় যুদ্ধ হয়েছিল বলে এর নাম হয় রণ ভাওয়াল। গফরগাঁও এলাকার অধিকাংশ অংশ রণ ভাওয়াল পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রাজা মানসিং কয়েকটি যুদ্ধে জিতলেও বাংলায় মোঘল আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হন। তিনি বাংলায় তার দুই ছেলেকে হারান এমনকি সম্রাট আকবরের সময় বাংলার শুধুৃ একাংশে মোঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মোঘল এলাকার পশ্চিমে রাজমহল, পূর্বে বগুড়া, শেরপুর, উত্তর ঘোড়াঘাট, দক্ষিণে সাতগাঁও ও বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ভাটিতে মোঘলদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। পূর্বে ও দক্ষিণে অন্যান্য ভূঁইয়া ও জমিদাররা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিত। আর্থাৎ বেকায়দায় পড়লে মোঘল বশ্যতা স্বীকার করত। প্রকৃতপক্ষে তারা স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করত।
এদের মধ্যে যারা মোঘলদের বিরদ্ধে যুদ্ধ করেন, তারাই বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। বার সংখ্যাটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছ। প্রকৃত পক্ষে ভূঁঁইয়াদের সংখ্যা ১২ জনের বেশি ছিল। বার ভূঁঁইয়াদের উৎপত্তি হয় বাংলার আফগান শাসনামলে। শের শাহের মৃত্যুর পর তার ছেলে ইসলাম শাহের রাজত্বকালে সোলায়মান খান বিদ্রোহ করেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর দিল্লিতে যেমন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বার ভুঞাঁর উদ্ভব হয়।
আকবরের সময় নেতাসহ বার ভূঁঁইয়ার সংখ্যা ছিল ১৩ জন। তারা হলেন: ঈশা খাঁ, মসনদ-ই-আলী (নেতা), ইবরাহীম নারাল, করিমদাদ, মুসাজাই, মজলিশ দিলাওয়ার, মজলিশ প্রতাপ, টিলাগাজী, বাহাদুর গাজী, সুলতান গাজী, সেলিম গাজী, কাসিম গাজী কেদার রায় ও শেরখান।
এলাকাবাসীর দাবি, এই ভূমি খেকোদের হাত থেকে ঐতিহাসিক জায়গাটি উদ্ধার করে -সরকার কতৃক গড়ে তোলা হোক পর্যটন কেন্দ্র।
ঈশা খাঁ ও মানসিংয়ের যুদ্ধক্ষেত্রটি পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় আনা সহ "৫২"ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনারটি কে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক ।একই মতামত দেন গফরগাঁও উপজেলার টাঙ্গাব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন সাগর।
এতে গফরগাঁও উপজেলা সহ ময়মনসিংহ বিভাগকে নিয়ে যাবে অন্য মাত্রায়।
এবিষয়ে গফরগাঁও উপজেলার সহকারী কমিশনার ভুমি -কাবেরী রায় বলেন, "বিষয়টি দুঃখজনক। ঐতিহাসিক ঘটনায় সমৃদ্ধ এই সরকারি জমি যদি দখলে নিয়ে থাকে তাহলে সঠিক তথ্যে ও তদন্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"