অতিথি পাখি 'অতিথি' হয়ে থাকতে পারছেনা, পাখি শিকার বন্ধে জনসচেতনা জরুরি
মোঃ আকিব হোসেন খান, (কিশোরগঞ্জ):
কিশোরগঞ্জ শহরের মুক্তমঞ্চ এলাকার নরসুন্দা নদীর পাড়কে সারাক্ষণ মুখরিত করে রাখে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। দলবেঁধে পাখিগুলো যখন আকাশে ওড়ে, তা দেখে মন ভরে যায় প্রকৃতিপ্রেমীদের। বাংলাদেশে আগত অতিথি পাখিদের মধ্যে সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, রাজহাঁস, বালিহাঁস, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা, কুলাউ ইত্যাদি প্রধান। গ্রীষ্মকালে সুমেরুতে বাস করে এবং বাচ্চা দেয়, হাঁস জাতীয় এমন পাখি শীতকালে বাংলাদেশে আসে। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। আর অন্য সব পাখিরা আসে পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে।
মওসুমী অতিথি পাখির কলরব আর গুঞ্জনে দেশের বিশেষ কয়েকটি স্থান মুখরিত হয়ে উঠে। এর মধ্যে বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মীরপুর চিড়িয়াখানা, চলনবিল, সুন্দরবনের কোনও কোনও স্থান, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এসব অতিথি পাখিদের প্রিয় অবকাশ কেন্দ্র। বাংলাদেশের জলাশয়গুলোই যেন এদের পছন্দের স্থান ও নিরাপদ আশ্রয়। বেশ কয়েক বছর যাবত নিঝুম দ্বীপ, দুবলার, চরকুতুবদিয়া এলাকাতেও শীতের পাখিরা বসতি গড়েছে বলে পযবেক্ষকরা জানিয়েছেন
অন্যান্য স্থানের মতো কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদের পুরো এলাকাও এসব পাখির কলকাকলীতে মুখরিত।
পাখিগুলোকে দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন পাখিপ্রেমীরা। মুক্তমঞ্চ এলাকায় নরসুন্দা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শান্ত জলের বুকে কচুরিপানার সবুজ গালিচার মধ্যে ঝাঁকবেঁধে ডানা মেলেছে পাখির দল। উড়ে চলা পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ।
নরসুন্দা নদীর এই স্থানে কয়েক বছরে ধরেই আনাগোনা বেড়েছে পরিযায়ী পাখির। প্রতিবছর শীত মৌসুমে এখানে বাহারি রকমের পাখির দেখা মেলে।
কাছে-দূরের অনেক মানুষ এসব পাখি দেখতে নরসুন্দা নদীর পাড়ে ভিড় করেন। পাখির ওড়াউড়ি যেমন নির্মল আনন্দ দেয়, তেমনই পাখি শিকারিদের উৎপাতের খবর দর্শনার্থীদের করে বেদনাহত। সেখানে দুষ্কৃতকারীরা রাতের আঁধারে বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে পাখি শিকার করেন বলে অভিযোগ আছে।
খাদ্য বিভাগ এ কর্মরত, কিশোরগঞ্জ এর উকিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ বাচ্চু খান বলেন, শীত এলেই পরিযায়ী পাখিরা নিজ আবাসভূমি ছেড়ে এখানে চলে আসে। সেই পাখিগুলোর বেশির ভাগই আবার তাদের নিজ ভূমিতে শীত শেষে ফিরে যেতে পারে না একশ্রেণির অর্থলোভী পাখি শিকারির অত্যাচারে। এটা খুবই মর্মান্তিক। পাখি প্রকৃতির অলংকার। এ অলংকার ধ্বংস করা মানে পরিবেশ ধ্বংস করা। এটি রক্ষায় আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার পাশাপাশি সচেতন হতে হবে।
নরসুন্দার তীরঁঘেষা পাখিপ্রেমি ও পাখি দেখতে আসাদের একজন খাদিজা আক্তার মুমু নামে স্থানীয় এক (নার্স) সেবিকার সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমাদের কিশোরগঞ্জে অতিথি পাখি 'অতিথি' হয়ে থাকতে পারছেনা, বাঁধনহারা এসব পাখি রক্ষায় জনসচেতনা জরুরি।
স্থানীয় হারুয়া এলাকার বাসিন্দা ও নরসুন্দা নদের পাড়ের ব্যবসায়ী খাইরুল ইসলাম জানান, পাখির কিচিরমিচিরে ভালো সময় কাটে এখানে। তবে কিছু দুষ্কৃতকারী রাতের আঁধারে বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে পাখি ধরে নিয়ে যায়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির বিচরণক্ষেত্র সুরক্ষার দায়িত্ব সবার। এ জন্য প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত।
স্থানীয় গুরুদয়াল সরকারি কলেজের প্রভাষক তপন তপু বলেন, শীত এলেই প্রচুর পাখি আসে এখানে। পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত থাকে পুরো এলাকা। তবে অসচেতনতা, সামান্য স্বার্থের কারণে বা শখের কারণে অনেকে শীতের পরিযায়ী পাখিদের শিকার করে মেরে ফেলছে। এতে সুন্দর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেন, যেকোন পাখিই শিকার খুবই অন্যায়। পাখিদের অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তবে শুধু আইন দিয়েই পাখি শিকার বন্ধ করা যাবে না; সর্বস্তরের মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এখানে পাখির অভয়াশ্রম করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। অতিথি এসব পাখি শিকার বন্ধ ও তাদের বাসস্থান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।