৬৮ বছরে ইত্তেফাক
আজ গণমানুষের মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাকের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। জনগণের সীমাহীন ভালোবাসাই দৈনিক ইত্তেফাককে দীর্ঘ পথচলায় প্রেরণা জুগিয়েছে। সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সময়ের দাবি মেটানো। সেই দিক থেকে দৈনিক ইত্তেফাক তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সময়ের দাবি মিটিয়ে এসেছে। জন্মলগ্ন থেকেই দৈনিক ইত্তেফাক বাংলাদেশকে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। যাদের ত্যাগ, পরামর্শ ও ভালোবাসায় দৈনিক ইত্তেফাক কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছে, তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। দৈনিক ইত্তেফাক গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। তাদের সীমাহীন প্রেরণা, ভালোবাসা ও ত্যাগের বিনিময়ে দৈনিক ইত্তেফাক আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। একই সঙ্গে স্মরণ করছে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে নিহত শহিদদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীরদের। মুক্তিযুদ্ধ ইত্তেফাকের নিরন্তর প্রেরণার উত্স।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে দৈনিক ইত্তেফাক এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আপসহীনভাবে সত্য প্রকাশ করে গেছে। একসময় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের স্বৈর সামরিক শাসক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। বাঙালির অধিকার রক্ষায় পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে বারবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সে সময় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করলে মানিক মিয়া ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সংবাদপত্রের প্রতি দেশের জনগণের যে বিশ্বাস তা ভঙ্গ করেননি। কোনো লোভ বা ব্যক্তিগত সুবিধার বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তিন বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন। পত্রিকার সাংবাদিকেরাও অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছিলেন, কিন্তু কেউই মাথা নোয়াননি। মানিক মিয়া আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচার শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে দৈনকি ইত্তেফাককেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় বারবার প্রবল প্রতাপে ফিরে এসেছে দৈনিক ইত্তেফাক।
মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া ও তাঁর ইত্তেফাক এক হয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে পরিণতির পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারই পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সে কারণে এটাও অনস্বীকার্য যে, দৈনিক ইত্তেফাক আর এই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন সমার্থক। বস্তুত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার গণতন্ত্রের প্রতি অনমনীয় অবস্থান ও ক্ষুরধার লেখনী দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। মানিক মিয়ার মানস দর্পণ ছিল যেন ইত্তেফাকের প্রতিটি পৃষ্ঠা। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার। গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত্ এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে এক টানে বদলে দিয়েছিলেন।
মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
‘মোসাফির’ শিরোনামে তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হূদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। মানিক মিয়া প্রচলিত অর্থে শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, বরং সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার আপসহীন মনোভাবের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকেরা বারবার তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর বারবার নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন তো বটেই, সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই দৈনিক ইত্তেফাক বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে সচেতন করতে সচেষ্ট থেকেছে। এরপর ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন—সবকিছুতেই দৈনিক ইত্তেফাক সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে রাজনীতির পথনির্দেশ করেছে। বাংলার মানুষ দৈনিক ইত্তেফাক পড়ে দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হতেন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। দৈনিক মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক আজাদ ছয় দফার বিরোধিতা করে। দৈনিক ইত্তেফাক ছয় দফার পক্ষে অবস্থান শুধু নয়, অন্যতম প্রচারকের ভূমিকা পালন করে। ১৬ জুন ১৯৬৬ ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন গ্রেফতার হন এবং পরদিন পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি নিউ নেশন প্রেসও বন্ধ করে দেয়। প্রায় ১০ মাস পর ১৯৬৭ সালের ২৯ মার্চ মানিক মিয়া মুক্তি পান। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশ করার জন্য সম্পাদকের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সম্পাদক সাফ জানিয়ে দেন, ‘ইত্তেফাক যদি তার ঐতিহ্য অনুসরণ করে প্রকাশিত হতে না পারে, তবে তিনি সেই ইত্তেফাক প্রকাশে আগ্রহী নন।’ অবশেষে প্রেস মুক্ত হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৬৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত থাকে এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন দেয় এবং সম্পাদকীয়, সচিত্র প্রতিবেদন, ফিচার প্রকাশ করে নানাভাবে সমর্থন দেয়, গড়ে ওঠে জনমত। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের অনীহা ও ষড়যন্ত্র এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও সর্বাত্মক অসহযোগের আহ্বান থেকে ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হওয়া—এই পুরোটা সময় দৈনিক ইত্তেফাক অনন্যসাধারণ ও গৌরবময় ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে নতুন বাস্তবতায় দৈনিক ইত্তেফাক নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে থাকে। রাজনৈতিক মুখপত্রের বলয় থেকে বেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে সাংবাদিকতা অগ্রসর হতে থাকে। সময়ের দাবি মেটাতে ইত্তেফাকের বিন্যাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু সত্য, ন্যায়, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো বদলায়নি। বদলাবেও না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই দায়ভার বহন করে যাবে।
করোনার কারণে-
করোনা মহামারির কারণে এ বছর ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন রাখা হয়নি।