মিত্রবাহিনীর অসাধারণ রণকৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী
আনোয়ার হোসেন:
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ রূপান্তরিত হয়েছিল পাক ভারতের মধ্যে এক সর্বাত্মক যুদ্ধে। এটিকে পাক ভারতের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।
উপমহাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সংক্ষিপ্ত সময়ে একটি যুদ্ধ পরিকল্পনা করা সহজ ব্যাপার ছিল না ।
সার্বিক লক্ষ্য অর্জনে, পাকিস্তানী সামরিক স্ট্রাটেজি, বিদেশি শত্রু ও মিত্রপক্ষের কার্যকরণ গত সম্পর্ক নির্ণয়ের ভিত্তিতে একটি কার্যকর, স্থিতিস্থাপক ও ব্যাপক প্ল্যান প্রস্তুত করতে হয়েছিল।
ইন্ডিয়ান চিফ অফ স্টাফ, জেনারেল মানেকশ এর নির্দেশে ইন্ডিয়ান আর্মি হেড কোয়ার্টারের মিলিটারি অপারেশন্স এর ডাইরেক্টর, লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে কে সিং এই যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন।
তাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে আরএফ জ্যাকব।
এই পরিকল্পনার লক্ষ্য গুলো নির্ধারণ করা হয়েছিল নিম্নলিখিত রূপে।
১। ক্ষিপ্র গতিতে আক্রমণ করে দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার পতন ঘটাতে হবে।
২। কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী শহর ঢাকা, একমাত্র সে দিকেই অগ্রসর হতে হবে।
৩। অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তির অপচয় করা যাবে না। সেগুলো কে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে।
৪। শত্রুপক্ষকে ধোকা দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। শত্রুকে বোঝাতে হবে যে তার চেয়ে অন্তত চার গুণ শক্তি নিয়ে মিত্রবাহিনী আক্রমণ করেছে।
৫। শত্রুবাহিনীকে বুঝাতে হবে যে চার দিক থেকেই মিত্র বাহিনী আক্রমণ করেছে। প্রতিপক্ষ যেন তার সৈন্যদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তীতে যেন আর জড়ো করতে না পারে।
৬। মিত্রবাহিনী যেন পাক বাহিনীর সঙ্গে কোথায়ও বড় ধরনের, দীর্ঘ লড়াইয়ে জড়িয়ে না পড়ে। মিত্রবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে রাখা।
৭। ঢাকামুখী অগ্রসর হতে হবে কাঁচা পথ দিয়ে। যেখানে পাকবাহিনী আশা করবে না, যেখানে পাকিস্তানিদের কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না, যেখানে কোন মাইন থাকবে না, যেখানে শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না, এবং যেখানে জনবসতি খুব কম।
৮। প্রথম থেকেই এমন ভাবে আক্রমণ চালাতে হবে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে যেন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল শুরুতেই ভেঙ্গে দেয়া যায়, এবং তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এই লক্ষ্য গুলোকে সামনে নিয়ে মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় চার দিক থেকে তার সেনাবাহিনীকে সুবিন্যাস্ত করে।
এই যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মুক্তিবাহিনী সহ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মিত্রবাহিনীকে সহযোগিতা করে। মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে নদী পার হয়ে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়েই অতি দ্রুত ঢাকার নিকটে চলে আসে।
বাংলার সাধারন মানুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকায় মিত্রবাহিনীর জন্য দ্রুততম সময়ে রাজধানী ঢাকার পতন ঘটানো অনেক সহজ হয়েছিল।
হাতেগোনা কিছু রাজাকার-আলবদর ছাড়া সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সহযোগিতা করেছিল মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের। যে কারণে মিত্রবাহিনী অতি সহজেই তাদের রণকৌশল বাস্তবায়ন করে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পেরেছিল।
এজন্যই দেখা যায় ১৬ ই ডিসেম্বরের পরেও দেশের কোন কোন জায়গায় পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। পরবর্তীতে ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর সেই ঘাঁটিগুলো গুটিয়ে তারা মিত্রবাহিনীর হেফাজতে চলে আসে।
(আনোয়ার হোসেন , ডিআইজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জ)