অভাবে বাড়ি ছাড়া সেই ছেলেটি এখন মালয়েশিয়ার শিল্পপতি
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
অভাবের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সেই ছেলেটি এখন মালয়েশিয়ায় শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশটিতে শ্রমিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিজের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে এখন নিজের প্রতিষ্ঠানে সেখানকার লোকদেরই কর্মী হিসেবে কাজ করাচ্ছেন তিনি। হাজার হাজার কর্মী কাজ করছেন তার প্রতিষ্ঠানে। প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চলছে।
তার প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন উচ্চ শিক্ষিতও অনেকে। নিজে অর্জন করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দাতো উপাধি।
তিনি হচ্ছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার হরিহরপুরের সরকারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ কারির উদ্দিন ও জলেখা বেগমের ছেলে দাতো মোহাম্মদ মিজান। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মিজান পঞ্চম। এই বৃহৎ পরিবারটি বেশ অভাবে ভুগছিল। অভাব অনটনের কারণে শৈশবেই কাজের সন্ধানে স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে।
১৯৯০ সালে পাশের গ্রামে একটি বাড়িতে কাজ করার সময় মালিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকায় চলে যান মিজান। পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না তার। ঢাকায় তিনি বিভিন্ন স্থানে কাজ শেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। সেখানে থেকেও হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। মাঝে কেটে যায় ১৭টি বছর। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ ছিল না। তিনি হয়ত আর বেঁচে নেই, এমন খবর পরিবারসহ তার এলাকার মানুষের মধ্যে ছিল।
হঠাৎ পাশের পীরগঞ্জ উপজেলার দুই যুবক খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হন মিজানের গ্রামের বাড়িতে। মিজানের বাবার ঘরবাড়ি দেখে ওই দুই যুবক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে মিজানের ছবি দেখে থমকে যান তারা। তাদের মাধ্যমে পরিবার জানতে পারে মিজান মালয়েশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। তার অধীনে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্যা লোক।
ওই দুই যুবক মালয়েশিয়াতে ফিরে মিজানকে জানান তার পরিবারের কথা। বাবা-মা, ভাই-বোনদের আর ভুলে থাকতে পারেননি মিজান। সীদ্ধান্ত নেন দেশে আসার। ২০১৪ সালে হেলিকপ্টারে করে মালয়েশিয়ান স্ত্রীসহ ঠাকুরগাঁও সুগার মিল স্কুল মাঠে এসে হাজির হন মিজান। তার আসার খবর ছড়িয়ে পরে এলাকায়। হাজার হাজার মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসে। ২৪ বছর পরে বাড়িতে ফেরায় পরিবারে আনন্দের বন্যা লাগে।
মালয়েশিয়াতে ফিরে ২০১৮ সালে আবারও বাড়িতে আসেন মিজান। ইতোমধ্যে ভাইদের জন্য আলীশান বাড়ি করে দিয়েছেন। এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহে ও দুস্থদের দান করে ইতোমধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।
জানা যায়, দাতো মিজানের কোম্পানিতে বেশিরভাগই বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত রয়েছেন। মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি আটটি নির্মাণ সেক্টরে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চালু রয়েছে। এসব সেক্টরে পুরোদমে কাজ চালু রাখতে আরও দুই হাজার কর্মী দরকার তার। কলিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়ে যাওয়ার জন্য দূতাবাসে চাহিদাপত্র জমা দিয়ে রেখেছেন মিজান।
ভাগ্যের অন্বেষণে ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে খালি হাতেই একটি নির্মাণ সেক্টরে শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মিজান। মেধা, পরিশ্রম আর দক্ষতার জোরে উন্নয়ন অব্যাহত থাকায় তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি এখন মালয়েশিয়ার প্রথম শ্রেণির শিল্পপতি। গড়ে তুলেছেন একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্স নামে বৃহৎ গ্রুপ প্রতিষ্ঠান।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা বলেন, তার কোম্পানিতে কর্মসংস্থানের সুযোগের ফলে অনেক পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তিনি বাংলাদেশের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। শ্রমিকদের সুখে দুঃখে পাশে থাকেন তিনি। এভাবেই সবার কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। তার একটাই স্বপ্ন বাংলাদেশে মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়া।
মিজানের মা জলেখা বেগম ছেলের সাফল্যে বেশ খুশি। তিনি বলেন, অভাবের সংসার ছেড়ে মিজান পালিয়ে গিয়েছিল। এখন হাজার হাজার মানুষের আয় তার মাধ্যমে।
দাতো মিজান বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এ পর্যন্ত আসার জন্য কারও কোনো সহযোগিতা পাইনি। নিজের চেষ্টায় এসেছি। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এবার দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে কিছু করতে পারব। অনেক বাংলাদেশি আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আরও প্রায় দুই হাজার লোক বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসব। অভাবে বাড়ি ছেড়েছিলাম। সেজন্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। পরিশ্রম কখনও বিফলে যায় না। তার উদাহরণ আমি নিজে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফজলে রাব্বী বলেন, দাতো মিজান এলাকার মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেক দান করেছেন। তার এই সাফল্যের সঙ্গে যেমন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বা আরও হবে, ঠিক তেমনই বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোও আরও বেগবান হবে।