ভারতের কাছে বাংলাদেশ সবসময়ই অগ্রাধিকারে : দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা
ভারতের কাছে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার সব সময়ই বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। গতকাল বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে তিনি এ মন্তব্য করেন।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুদিনের সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব গত মঙ্গলবার ঢাকা এসেছিলেন। মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি। গতকাল বুধবার তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, আমি একটি সংক্ষিপ্ত সফরে হঠাৎ এসেছি। গতকাল আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন কভিড পরিস্থিতির কারণেই তিনি কারো সঙ্গে দেখা করছেন না। আমার আসার কারণ হলো, আমার প্রধানমন্ত্রী অনুভব করেছেন যে কভিড সময়ে তেমন যোগাযোগ করা হয়নি। কিন্তু সম্পর্ক চলমান রাখতে হবে। আমাদের শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আমি প্রাথমিকভাবে এ বিষয়টি নিয়েই এসেছি।
করোনার টিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কী পদক্ষেপ নিয়েছি, তা আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। বাংলাদেশের মতো আমাদের জনসংখ্যা প্রচুর। ফলে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। সৌভাগ্যবশত মৃত্যুর সংখ্যা কম ও সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যা বেশি। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। টিকা পরীক্ষা নিয়ে আমরা বর্তমানে দ্বিতীয় ধাপে রয়েছি। বর্তমানে এটি অ্যাডভান্সড পর্যায়ে রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে টিকা উৎপাদন করা হবে। আপনারা জানেন যে বিশ্বের ৬০ শতাংশ টিকা ভারত উৎপাদন করে। আর কভিডের টিকা সফল হলে প্রতিবেশী দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে বাংলাদেশ সব সময়ই প্রাধান্য পায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির বার্তা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব একটি সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ এসেছেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের দেড় ঘণ্টার বৈঠকটি ব্যতিক্রমী উষ্ণ, স্পষ্ট ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অনেক বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ মোকাবেলায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির প্রতিবেশী প্রথম নীতি অনুযায়ী ভারতের কাছে বাংলাদেশ প্রথম এটি বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পুনর্ব্যক্ত করেন।
বৈঠক থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ভারত বর্তমানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য। বাংলাদেশ এ বিষয়ে ভারতকে সমর্থন করেছে। আমাদের একটি উদ্বেগের জায়গা রয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে একটি রেজল্যুশন পাস করা যায়। তবে কিছু স্থায়ী সদস্যের কারণে আমরা করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমরা ভারতের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে বলতে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আর আগামীতে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা নিয়ে যেসব আলোচনা হবে, তাতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ।
বৈঠকে সম্পর্কের যে অস্বস্তিগুলো রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বৈঠকে সীমান্ত হত্যার মাধ্যমে ভারত চুক্তি ভঙ্গ করছে বলে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যা একটি সমস্যা। সে বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আগামী মাসে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমরা চেষ্টা করব। সে বৈঠকের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিএসএফের মহাপরিচালককে দিকনির্দেশনা দেবেন, যাতে করে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমরা এড়াতে পারি। চলতি বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসে আগের তুলনায় বেড়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, ভারতের কিছু জায়গায় বাংলাদেশী আটকে রয়েছে। দুবরি অঞ্চলে ২৬ জন জেলে আটকে রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত তাদের দ্রুত বাংলাদেশে ফিরে আসার বিষয়ে সহযোগিতা করবে। সেই সঙ্গে তবলিগ জামাতে গিয়ে বাংলাদেশীরা আটকে পড়েছে। তাদের একটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাড়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু বাংলাদেশী ফিরে এসেছেন। আরো শতাধিক রয়েছেন। তাদের বিষয়টিও যতটুকু দ্রুত করা যায় সে সমস্যার সমাধান হবে।
তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন, দিল্লির বিশেষ বার্তা ও সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তিস্তায় চীনা অর্থায়ন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আর দিল্লির বিশেষ বার্তা হচ্ছে কভিডের সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। তারই পরিবর্তন হিসেবে আমরা দেখছি এ সফরটিকে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এতটাই গুরুত্ব দেয় ভারত, ঢাকাকেই নির্বাচন করেছে প্রথম সফরের জন্য। তারা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো বেগবান করতে চান।
তিনি বলেন, ভারতের সংবাদমাধ্যমে ইদানীং যা দেখতে পেয়েছি, সে বিষয়ে আমরা পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আর একমত হয়েছি যে আমরা আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমে সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার বার্তা প্রচার করব।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি এয়ার বাবল নিয়ে গতকাল ভারতের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছি। কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভারতের এ-সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে ভারত এয়ার বাবল নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করব, দ্রুত আমরা চুক্তিটি করে ফেলতে পারব। এছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুদেশের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে একমত হয়েছি আমরা।
তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। লাইন অব ক্রেডিটের প্রকল্প, বিদ্যুতের প্রকল্প এবং বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের কিছু কাজ থেমে গিয়েছিল। কারণ ভারত থেকে বিশেষজ্ঞরা যারা কাজ করছিলেন তারা অনেকে কভিডের কারণে চলে গিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ আবার আসা শুরু করেছেন। আমাদের অর্থনীতি যখন আরো গতি ফিরে পেতে থাকবে, আমরা তত তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করব। সেসব বিবেচনায় এনে এয়ার বাবলটি শুরু হতে পারে শিগগিরই।
মুজিব শতবর্ষ উদযাপন নিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, কভিডের কারণে আমাদের অনেকগুলো অনুষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয়েছে। বাকি যে সময়টুকু রয়েছে, তার মধ্যে বাকি অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে করব তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন রাজধানীতে ভারত ও আমরা যৌথভাবে অনুষ্ঠান করব। তারা আমাদের সহযোগিতা করবে অনুষ্ঠানগুলোতে।
তিনি বলেন, আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী শুরু হবে। সেই সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি। সে উপলক্ষে আমরা আলাদাভাবে অনুষ্ঠান করছি।
এছাড়া দুই দেশের মধ্যে ভিসা কার্যক্রম আবারো চালু করা এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চলাচল শুরু করার জন্য ভারতকে অনুরোধ করে বাংলাদেশ।