ব্যাংকঋণের জন্য নির্বিচারে পারসোনাল গ্যারান্টি কেন
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
ব্যক্তিগত কিছু প্রয়োজন মেটানোর জন্য দেশে একটি বাণিজ্যিক বাংকে নগদ জামানতের বিপরীতে একটি ঋণসীমা বা ওভারড্রাফট ফ্যাসিলিটি নিয়ে রেখেছি। নগদ জামানতের বিপরীতে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করার কারণে দেশে গেলে সেই ব্যাংকের অফিসার একগুচ্ছ কাগজপত্র ধরিয়ে দেন স্বাক্ষর করার জন্য। এসব কাগজের মধ্যে একটি ডকুমেন্ট হচ্ছে ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা পত্র বা পারসোনাল গ্যারান্টি। আমি অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নগদ জামানত ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত রেখে তার অর্ধেক পরিমাণ ঋণসীমা নিয়ে রেখেছি। এ জন্য আমি সমুদয় নগদ জামানতের ওপর ব্যাংকে পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে রেখেছি, যার ভিত্তিতে ব্যাংক যখন চাইবে তখনই আমার সমুদয় নগদ জামানত ভাঙিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করে নিতে পারবে। এর পরও কেন আমাকে পারসোনাল গ্যারান্টিতে স্বাক্ষর করে দিতে হবে, তা আমার কাছে কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। বিষয়টি সেই ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাকে জানালেন যে এটাই নিয়ম। এটা নিয়ম না অনিয়ম তা সম্ভবত অনেকেই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশে ব্যাংকে চাকরি করার সময় আমি নিজেও সেই ব্যাংকারের মতো না বুঝেই এ রকম অনেক পারসোনাল গ্যারান্টি নিয়েছি। আমি জানি যে এটা আমাদের দেশের ব্যাংকঋণের ডকুমেন্টেশনের এক মারাত্মক দুর্বলতা, যা আমরা সেই পাকিস্তান আমল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, এখনো তা বহাল তবিয়তে চলছে। তাই সেই ব্যাংকার আমার প্রশ্নের যেমন সদুত্তর দিতে পারবেন না, তেমনি আমিও আমার পারসোনাল গ্যারান্টি না নিয়েও থাকতে পারব না। তাই কথা না বাড়িয়ে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করে দিলাম। অথচ এই পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষরের পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। এরই মধ্যে অনেকেই বুঝে হোক আর না বুঝে হোক এভাবে পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করে বেশ ভালো বিপদের মধ্যে আছেন।
পারসোনাল গ্যারান্টি কী? পারসোনাল গ্যারান্টি একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট, যার মাধ্যমে একজন নিশ্চয়তা প্রদানকারী কোনো কিছু সম্পাদন করা বা সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দেওয়ার ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে। এই আইনি দলিল মারাত্মক এক ডকুমেন্ট, যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা প্রদানকারীকে ব্যাংকের সমুদয় ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা যায়। প্রয়োজনে সেই নিশ্চয়তা প্রদানকারীর ব্যক্তিগত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে এই পারসোনাল গ্যারান্টির বদৌলতে গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা যায়। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ডকুমেন্ট কোন নির্দিষ্ট আইনের অধীনে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তা আমাদের মতো সাধারণ ব্যাংকারদের কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। এই পারসোনাল গ্যারান্টি কী চুক্তি আইনের অধীনে, নাকি কম্পানি আইনের অধীনে, নাকি সিআরপিসি/সিপিসি বা অন্য কোনো আইনের অধীনে কার্যকর করা হয়, তা আজও নিশ্চিত হতে পারিনি।
পারসোনাল গ্যারান্টি কখন প্রয়োজন? আমাদের দেশে যেভাবে নির্বিচারে যেকোনো ব্যাংকঋণের বিপরীতে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়া হয়, তা কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ হতে পারে না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে পারসোনাল গ্যারান্টি আইনগতভাবেই নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। অন্য সব ক্ষেত্রে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিগত ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঋণগ্রহীতা আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য। প্রয়োজনে তাঁর ব্যক্তিগত সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও সেই ব্যক্তিগত ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে বাধ্য। তাহলে ব্যক্তিগত ঋণদানের ক্ষেত্রে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার এমন কী হেতু থাকতে পারে।
অংশীদারি কারবারের ক্ষেত্রে যে অংশীদার সচ্ছল তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠানের সমুদয় ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও। আর যাঁর সামর্থ্য নেই তেমন অংশীদারের পারসোনাল গ্যারান্টি নিলেই কী, আর না নিলেই কী। সক্ষম অংশীদার পারসোনাল গ্যারান্টি দিক আর না দিক, তিনি অংশীদারি আইন অনুযায়ীই ফার্মের নামে নেওয়া সমুদয় ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য। অংশীদারি কারবারে যেখানে আইনগতভাবেই অংশীদাররা ব্যাংকের সমুদয় ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য, সেখানে এই পারসোনাল গ্যারান্টির এমন কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? শুধু লিমিটেড কম্পানির ক্ষেত্রে এই পারসোনাল গ্যারান্টির প্রয়োজনীয়তা আছে, তা-ও সব ক্ষেত্রে নয়।
কম্পানি আইন অনুযায়ী পরিচালকরা কম্পানি পরিচালনার জন্য কখনোই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন না। কম্পানি নিজ নামেই পরিচালিত হয় এবং কম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করা যায়। তাই কোনো কম্পানির পরিচালককে যদি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করার প্রয়োজন হয়, শুধু তখনই পারসোনাল গ্যারান্টি নিতে হয়। বাস্তবে যেখানে কম্পানির সুনাম, সুখ্যাতি ও সচ্ছলতা পরিচালকদের থেকে অনেক ওপরে, সে ক্ষেত্রে আর পারসোনাল গ্যারান্টির প্রয়োজন হয় না। যে ক্ষেত্রে কম্পানি গৌণ, এর মালিক বা পরিচালকই মুখ্য, শুধু সে ক্ষেত্রেই পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়া হয়ে থাকে। অন্য সব ক্ষেত্রে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়া, না নেওয়ার ফলে ব্যাংকঋণ আদায়ে তেমন কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
পারসোনাল গ্যারান্টির পরিণতি কী? পারসোনাল গ্যারান্টি কঠিন একটি আইনি ডকুমেন্ট, যা স্বাক্ষর করে যে কেউ মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে পারেন। নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সহায়-সম্পত্তি দিয়ে হলেও সেই ঋণ পরিশোধে বাধ্য থাকবেন। এমনকি যে পরিমাণের ঋণের কথা জেনে পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করবেন, বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতার হিসাবে যত ঋণ থাকবে তার পুরোটাই পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন পারসোনাল গ্যারান্টির কারণে। এমনকি জালজালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের টাকা উত্তোলন করা হলেও সেই অর্থ ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা প্রদানকারী পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। কারণ ব্যাংকঋণগ্রহীতার হিসাবে যে ঋণের অর্থ লেখা থাকবে সেটাই দাবি করে বসবে। অথচ জালজালিয়াতি প্রমাণ করতে অনেক সময় লেগে যায়।
এ ছাড়া পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করার কারণে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে পারসোনাল গ্যারান্টি প্রদানকারীও খেলাপি হয়ে যান এবং তাঁর নামে সিআইবিতে রিপোর্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে খারাপ দিক যে ব্যাংকে কর্মকর্তারা কোনো কিছু না লিখে ব্ল্যাংক পারসোনাল গ্যারান্টিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকাররা সুযোগমতো তারিখ এবং টাকার পরিমাণ বসিয়ে নেন। এই প্র্যাকটিস সবচেয়ে মারাত্মক ও অবৈধও বটে। অধিকন্তু এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট নেওয়ার আগে পারসোনাল গ্যারান্টি প্রদানকারীকে এই ডকুমেন্ট স্বাক্ষর করার উদ্দেশ্য এবং এর পরিণতি সম্পর্কে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। উল্টো এমন ধারণা দেওয়া হয় যে এটি খুবই সাধারণ একটি কাগজ, কোনো মতে স্বাক্ষর করে দিলেই হয়। এতে তেমন কিছুই হবে না।
ফলে বেশির ভাগ মানুষ ভালোভাবে না বুঝেই এই পারসোনাল গ্যারান্টি স্বাক্ষর করে দিয়ে থাকেন। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি যে এই পারসোনাল গ্যারান্টির কি মারাত্মক পরিণতি হতে পারে তা তাঁরা জানেন কি না। প্রত্যেকেই না বলেছেন এবং এটাই স্বভাবিক। কারণ বেশির ভাগ ব্যাংকার বিষয়টি ভালো করে বুঝিয়ে এই গ্যারান্টি নেন না।
এই পারসোনাল গ্যারান্টি দিয়ে অনেকেই বিপদের মধ্যে আছেন। আইনগতভাবে প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক নির্বিচারে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়া হয়ে থাকে যেকোনো ধরনের ব্যাংকঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে। আমার বিশ্বাস, কেউ বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে গেলে এ ব্যাপারে ন্যায়বিচার বা ভালো নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
এভাবে সব ঋণের বিপরীতে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়া বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শুধু লিমিটেড কম্পানির ক্ষেত্রে যেখানে আইনগতভাবে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে শুধু সে ক্ষেত্রেই পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার বিধান রাখা প্রয়োজন। অন্য সব ক্ষেত্রে পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার প্রচলন বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নগদ জামানতের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণের জন্য পারসোনাল গ্যারান্টি নেওয়ার প্র্যাকটিস অনতিবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। আমাদের দেশে তৃতীয়পক্ষের পারসোনাল গ্যারান্টির ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়ার একটি খুবই খারাপ প্রবণতা আছে, যা বন্ধ করতে হবে। যদি ঋণগ্রহীতা ঋণ গ্রহণের জন্য যোগ্য না হন, তাহলে তাঁকে কোনো অবস্থায়ই ঋণ দেওয়া উচিত নয়, তা সে যতই পারসোনাল গ্যারান্টি আনুক বা জামানত প্রদান করুক না কেন। আমরা আশা করব, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং এ ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।