১৯৭১ : শরণার্থী জীবন ও অক্সফাম
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তি আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়, এই বিজয় এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক স্বপ্ন ও জীবনের বিনিময়ে, অনেক আশা ও সাধনার উচ্ছ্বাসে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী তথা ধর্ম, জাতি, শ্রেণি, নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি- বাংলাদেশ। সেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সর্বস্ব ফেলে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল এক কোটি বাঙালি। শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেটাও ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে করছিল গড়িমসি। তার পর মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের আন্দোলন দমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চের ‘কালরাতে’ শুরু করল তাদের বাঙালি নিধন অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
নিরপরাধ, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর তারা চালাল এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ (সেই রাতেই তাকে গ্রেপ্তারের আগে, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা)। শত শত বাঙালিকে সারিবদ্ধ করে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, ধর্ষণ করেছে নারীদের- যার ফলে, নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বেদনাদায়ক স্মৃতি নিয়ে লাখ লাখ লোক তাদের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য, বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধারণা, হিন্দুরা ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জন্য দায়ী। তাদের ভোটেই নাকি আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিমও তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের সামাল দেওয়া ভারতের জন্য একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াল- অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে। কিন্তু ভারত সরকার এবং সেই দেশের সাধারণ জনগণ শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাদের সাহায্য প্রদানে এগিয়ে এলেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান জনাকীর্ণ অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ত্বরিতগতিতে ব্যবস্থা নিতে শুরু করল।
কিছুসংখ্যক শরণার্থী অবশ্য তাদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়ের বাড়িতে থেকেছিলেন। আমাদের পরিবারকেও ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ের পথে হেঁটে রামগড়ে পৌঁছে, সাব্রুমে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। সাব্রুম থেকে সড়কপথে আগরতলায়, সেখানে একটি কলেজের হোস্টেলে ছিলাম তিন দিন। এর পর বাসে ও রেলে মেঘালয় ও আসাম হয়ে চার দিনের আরেক কষ্টসাধ্য যাত্রা শেষে পৌঁছালাম কলকাতায়। সেখানে পার্ক সার্কাস এলাকায় বাংলাদেশ মিশনের পেছনে মেহের আলী রোডে একটি ভবনে দুটো কামরায় থাকতাম আমাদের যৌথ পরিবারের আঠারো জন সদস্য। তখন কলকাতাতেই আমি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান অক্সফ্যামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। তারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ছয় লাখ শরণার্থীর দেখাশোনা করত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, সেই সঙ্গে আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যেও। ওই সময় আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রধান কাজকর্ম পরিচালিত হতো কলকাতা থেকেই, ত্রাণ সংস্থাগুলো তাদের দপ্তর গড়ে তুলেছিল সেই শহরেই।
আমার মনে আছে, একদিন কলকাতায় চৌরঙ্গীতে হঠাৎ আমার স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ ব্রাদার রেমন্ড কোরনোয়ারের সঙ্গে দেখা। তাকে সব সময় দেখেছি পাদ্রীর পোশাকে, তাই আমাদের মতো সাধারণ পোশাকে প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। তিনি আমাকে দেখে খুশি হলেন, আমিও বেশ উচ্ছ্বসিত। কেমন আছি, আমার পরিবারের সবাই কেমন আছে জানতে চাইলেন। তার পর আমাকে নিয়ে গেলেন নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেলে। সেখান ছিল অক্সফ্যামের শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা ও সমন্বয় দপ্তর। ব্রাদার রেমন্ড ১৯৬৫ সালে কানাডায় ফিরে যান। এর পর তিনি কুইবেকে অক্সফ্যামে যোগ দেন এবং ১৯৭১ সালে তাকে ভারতের পূর্বাঞ্চল ও পূর্ব পাকিস্তানে অক্সফ্যামের ডাইরেক্টর নিয়োগ করা হয়। শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনার জন্য কলকাতায় একটি প্রশাসনিক দপ্তর খোলেন। সেই কেনিলওয়ার্থ হোটেলেই আমার পরিচয় হয় আরেক ইংরেজ জুলিয়ান ফ্রান্সিসের সঙ্গে, যিনি ছিলেন অক্সফ্যামের ত্রাণ কর্মসূচির সমন্বয়ক। ব্রাদার রেমন্ড আমাকে তার পরদিন থেকেই কাজ শুরু করতে বললেন। আমাকে প্রথমে দেওয়া হলো পণ্যাগারের দায়িত্ব। ধর্মতলায় ছিল তাদের বিশাল পণ্যাগার যেখানে ত্রাণসামগ্রী যেমন- কম্বল, বাসন, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী রাখা হতো আর সেখান থেকেই পাঠানো হতো অক্সফ্যামের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে।
আমার মতো যারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে তাদের জন্য কিছু করতে পারছি, এটা ভেবে ভালো লাগছিল, আমাকেও তো তাদের মতো শিবিরে থাকতে হতো। মাসখানেক পণ্যাগারের এই দায়িত্ব পালনের পর, জুলিয়ান আমাকে একদিন অফিসে ডাকলেন এবং আরও বড় একটি দায়িত্ব নিতে বললেন। আমার কাজ হবে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে অক্সফ্যাম পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেখানকার কাজ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, তার পর শিবিরগুলোর প্রয়োজনীয়তা এবং করণীয় সম্পর্কে সাপ্তাহিক প্রতিবেদন লিখে জুলিয়ানকে দেওয়া। নিজে একজন শরণার্থী হয়ে ওই বয়সে অক্সফ্যামের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল নিজেকে। আমার এই কাজে জুলিয়ান আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন, উৎসাহ দিয়েছিলেন। সপ্তাহে ছয় দিন শিবিরগুলো পরিদর্শনে যেতাম আর সবকিছু লিখে রাখতাম। একদিন অফিসে বসে ছয় দিনের কাজ নিয়ে প্রতিবেদন লিখে জুলিয়ানকে দিতাম। তিনি সেগুলো দেখে পাঠিয়ে দিতেন অক্সফোর্ডে অক্সফ্যামের সদর দপ্তরে।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এর পরের করণীয় নির্ধারণ করা হতো। আমাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় এমন কোনো ঘটনা আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল কিনা। প্রত্যেকটা দিনই ছিল মনে দাগ কাটার মতো, যখনই দেখতাম শরণার্থীরা ত্রাণসামগ্রীর জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তাম। আমিও তো তাদের মতো একজন। ভাবতাম, এদের তো এই করুণ অবস্থায় থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়তাম যখন ওই সারিগুলোতে পরিচিত লোকজনকে দেখতাম। তবে এটা ভেবেও ভালো লাগত যে, তাদের সামান্য সাহায্যে হলেও কিছুটা করতে পেরেছি এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে অক্সফ্যাম। আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধে এটা ছিল আমার অতিসামান্য অবদান। এই বিশাল ত্রাণ কর্মসূচি ছাড়া অক্সফ্যাম আর খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ তখন করেছিল সেটা হচ্ছে ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি দলিল প্রকাশনা। বিশ্বনেতাদের চোখ খুলে দেওয়া এবং শরণার্থীদের এই ট্র্যাজেডি সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে বিশ্বের ষাট জন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাদের কথা লেখেন এই দলিলে। তাদের মধ্যে ছিলেন মাদার তেরেসা, সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, এন্টনি মাসকেরেনহাস, টনি পিলজার, নিকলাস টমালিন এবং মারটিন উলাকটের মতো সাংবাদিকরা।
১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ দলিলের প্রতি মার্কিন সিনেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং আটাশে অক্টোবর ১৯৭১-এ এই দলিলের পুরোটাই মার্কিন কংগ্রেসের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়। এই দলিল প্রকাশে অক্সফ্যাম এবং জুলিয়ানের অবদান অনস্বীকার্য। ষোলোই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে শরণার্থী শিবিরগুলোতে যে উচ্ছ্বাস ও আনন্দের চিত্র দেখেছি তা কোনোদিন ভুলব না। শরণার্থীরা যে এখন তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন, এই চিন্তাই ফুটে উঠেছিল তাদের চেহারায়। শিবিরের সবখানেই ধ্বনিত হতে লাগল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তারা যে ফিরে যাবেন তাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে। লাখ লাখ শরণার্থী যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল, তখন সুশৃঙ্খলভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অক্সফ্যাম এক বিশাল প্রত্যাবাসন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সীমান্তে দেখা দেয় স্বাস্থ্য ও পয়ঃপ্রণালি সমস্যা। হাজার হাজার শরণার্থীকে দিনের পর দিন বনগাঁয় আটকে থাকতে দেখেছি।
আমাদের জরুরিভিত্তিতে তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী, পানীয় জল এবং সেই সঙ্গে পয়ঃপ্রণালির সুযোগ-সুবিধা করে দিতে হয়েছিল। এক কোটি লোকের শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই অধ্যায়ের খুবই ছোট একটি অংশ হতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, ধন্যবাদ জানাই অক্সফ্যামকে তাদের বিশাল ও প্রশংসনীয় শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচির জন্য।
লেখক : উদয় শঙ্কর দাশ।