মুরাদ হাসান ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান একসময় বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক। ১৯৯৫ সালে মমেক শাখা ছাত্রদলের যে কমিটিতে মুরাদ হাসান পদে ছিলেন, সেই কমিটির একটি কপি যুগান্তরের হাতে এসে পৌঁছেছে।
ক্ষমতার পালাবদল হলে মুরাদ হাসান ভোল পাল্টে ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাজনীতিতে বাঁকবদলের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা মুরাদ। ১৯৯৮ সালে তিনি ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক পদে থেকেই সরাসরি ছাত্রলীগে যোগ দেন। রাতারাতি সাচ্চা ছাত্রলীগার হিসেবে নিজেকে জাহির করেন মুরাদ। ছাত্রলীগে গিয়েও তিনি দাপট দেখিয়ে কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। এর দুই বছর পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পদ পেয়ে যান মুরাদ।
মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পান ১৯৯৩ সালে। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় ছত্রছায়ায় থাকতে ও রাজনৈতিক সুবিধা নিতে তখন ছাত্রদলের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা।
মুরাদ ছাত্রদলের যে কমিটিতে প্রচার সম্পাদক ছিলেন, সেই কমিটির অনুমোদন দেওয়ার চিঠিতে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে মমেক শাখা সভাপতি পদে পদ দেওয়া হয় সাইদ মেহবুব উল কাদির। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো. ইসহাক। কমিটি অনুমোদন দেন তৎকালীন জেলা ছাত্রদল সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, মুরাদ হাসান ১৯৯৪ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তৎকালীন মেডিকেল কলেজ ছাত্রদল নেতারা মুরাদকে কমিটিতে জায়গা দেন, আমি সেই কমিটির অনুমোদন করি। '৯৬-তেও সে ছাত্রদলের নেতা ছিল। পরে সে ছাত্রলীগের চলে যায়। বাবা মতিউর রহমান তালুকদার আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ায় তাকে ছাত্রলীগে পদ পেতে বেগ পেতে হয়নি।
বিএনপি শীর্ষ এক নেতার পরিবারকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের পর ঢাকাই সিনেমার এক নায়িকার সঙ্গে মুরাদ হাসানের একটি ফোনালাপের অডিও ভাইরাল হয়ে যায়। যেখানে ওই নায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দিতে শোনা যায় মুরাদকে। পরিপ্রেক্ষিতের দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুরাদ হাসানকে মঙ্গলবারের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
সেদিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, মুরাদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলের যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জঘন্য, নিকৃষ্ট কথাবার্তা বলছেন। কাকে নিয়ে করছে? একজন ভুঁইফোড় ডাক্তার ছিল শুনেছি, সম্ভবত জামালপুরের সরিষাবাড়ীর। এটিও শুনেছি সে নাকি একসময় ছাত্রদল করত। দুঃখের কথা, দুর্ভাগ্যের কথা। আগে সে ছাত্রদল করত। সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রচার সম্পাদক ছিল। পরবর্তীকালে সে ছাত্র লীগে জয়েন করেছে। ধিক্কার দিই আমি তাকে। সেইম।’
ফখরুলের বক্তব্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে। মুরাদ বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে যুক্ত হয়েছিলেন বলে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের ৭১ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে সভাপতি ছিলেন মাহবুব-উল কাদির ও মো. ইসাহাক।
ডা. ইসাহাক গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের কমিটিতে প্রচার সম্পাদক ছিলেন মুরাদ। তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে এম-৩০ ব্যাচে মুরাদ হাসান এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। পরে মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রদলের কমিটির নেতারা সবাই ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যান। কিন্তু মুরাদ হাসান ক্যাম্পাসেই থেকে যান এবং ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ছাত্রলীগে যোগ দেন।
তিনি আরও বলেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান তার পিতার ক্ষমতার জোরে ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে পদ বাগিয়েছেন। মুরাদ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়। অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই আমলেই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী।
জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াহাব আকন্দ মঙ্গলবার জানান, মুরাদ হাসান ছাত্রদল করত। একটা পর্যায়ে পদ পেয়ে বেপরোয়া হলে ছাত্রদল তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। পরে সে ছাত্রলীগে গিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ওই সময়ে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম রিপনও গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে মুরাদ হাসানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ২০০০ সালে ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সভাপতি হন মুরাদ হাসান। তিন বছর পর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পান।
৪৭ বছর বয়সি মুরাদ তার নিজের এলাকা জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের ‘স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক’। তার বাবা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
এদিকে ডা. মুরাদ হাসানের ‘অপ্রত্যাশিত ফোনালাপে’ বিব্রত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় দুই নেতা বলেন, একজন রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে মানুষের জন্য কাজ করা। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান বিসর্জন দিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করলে শুধু সেই ব্যক্তিই যে সমালোচিত হন তা নয়, তার দল ও দলের নেতারাও বিব্রত হন।
এদিকে আওয়ামী লীগের একটি সূত্রের দাবি— মন্ত্রিত্বের পরে দলের পদ এবং আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে মুরাদকে। এতে তিনি হারাতে পারেন সংসদ সদস্য পদও।