নজরটিপ
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
বাম হাত থেকে কাজলদানিটা নামিয়ে রেখে পুত্রের মাথা পল্লবিত পাঁচ আঙুলে বেষ্টন করে আবার সে ডানহাত এগিয়ে নিয়ে আসে, সেখানে মধ্যমার মাথায় ঘন কাজল লেপটে আছে। আঙুল ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে কপাল কুঁচকে দু চোখের দৃষ্টি একত্রিত করে, তীক্ষভাবে নিরীক্ষণ করে সঠিক জায়গাটি।
আঙুল একটু সরিয়ে নেয় বামে, আবার সরিয়ে নেয় ডানে, এবার সেখান থেকে একচুল পরিমাণ বামে সরায়। কয়েকবার নড়ানড়ি সরাসরি করে এইবার নিজের মধ্যমা বসিয়ে দেয়, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের শিমুলডালে বসা লক্ষ্মীপেঁচাটা ডেকে ওঠে ‘কাঁত!’
এতক্ষণ ধরে বুকে চেপে রাখা বাতাসটাকে সে তৃপ্তির সঙ্গে মুক্তি দেয়। তার কুঁচকানো কপাল কলাপাতার জমিনের মতো সোজা হয়ে চকচক করে ওঠে, হ্যাঁ এবারে ঠিক হয়েছে। ডান নয়, বাম নয়, ঠিক জায়গামতো হয়েছে। দুপা পিছিয়ে সে আবার তাকায়, ত্যাড়াবাঁকাও না একদম গোল হয়েছে, পুন্নিমার চান্দের মতোন গোল। মধ্যমা নিজের মাথার চুলে ঘষতে ঘষতে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মন অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে, ভাবে তার কোলে বেটার মতো এক বেটা হইছে। ওর নিজের গায়ের রং মাজা মাজা কিন্তু বেটা হইছে এক্কেরে বাপের মতন, বাপের রংও অতটা গোরা না, বেটার রং যতটা।
মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছেলে এবারে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে তার নিজস্ব এ্যা আ দিয়ে, এর মধ্যে কোলের সন্তান সামলে, ছেলের বাবা সামান্য ঝামরে ওঠে—কই হইলো তোমার? দেও এবার পিরান, প্যান্টটা পিন্দায় দেও, দেরি হইলে ফির আন্ধার হয়া যাইবে এলা।
—না, না, এই টপকরি ঘুরি আইসেন, বেশি রাইত করেন না। রাইতের বেলা কোলার ছইল নিয়া ঘোরাঘুরি ভালো না, বলতে বলতে, একজোড়া হাঁস বিক্রি করে, সেই টাকায় দুদিন আগে কিনে আনা লাল টুকটুকে পিরান আর প্যান্টটা পরিয়ে দেয়।
ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে এই তরুণী মা তার পুত্রকে সাজাচ্ছে। কপালে এঁকে দিচ্ছে নজরকাটা টিপ। যে টিপ দিলে কারো কুনজর লাগবে না। কোনো অমঙ্গল স্পর্শ করবে না।
কান পাতলে শোনা যায় মায়ের বুকের ধুকপুক! সঙ্গে শোনা যায় সন্তানের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা। বাপ-বেটাকে বিদায় দিয়ে সে সাঁঝবাতি জ্বালায়, ঘর-দোরে আলো দেখায়, সমস্ত অমঙ্গল যেন দূর হয়ে যায়। চুলার পাশে শুকনো ডাল পাতা জোগাড় করে রাখে। শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে হাতে হাতে ভাঁজ করে ঘরে রাখে। সান্ধ্যকালীন সব কাজ সমাপ্ত করে আবার ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। জন্মের পরে এই প্রথম ওদের পুত্র বাবার কোলে চড়ে বান্নি দেখতে গেছে।
মানসপটে ভেসে ওঠে—বাবার আঙুল ধরে শৈশবের বান্নি দেখা—কুঁচি কুঁচি ঘেরের ফোলা ফোলা জামা পরে নাগরদোলায় দোল খাওয়া। পুরো বান্নিজুড়ে টমটম গাড়ি, কাচের চুড়ি, কদমা, বাতাসা, নকুলদানা, মোয়া, খোরমা, আরো যে কতকিছু! কিন্তু সেইসঙ্গে ভয়ার্ত এক স্মৃতি…বান্নিতে মানুষ আর মানুষ। মনে হয় ওর মতো ছোটদের সংখ্যাই অধিক কিন্তু একসময় সেটা হয়ে যায় আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে, কালো ধোঁয়া অজগরের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠতে থাকে। মানুষ দুভাগ হয়ে যায়। একদিকে একদল আর আরেকদিকে অন্যদল। কেউ কারো কথা শোনে না, কারো দিকে তাকায় না। কেবল আঘাত হানো, কেবল নির্মম আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়। নিধন কর, নিধন কর। ওকে মারো ও শালা ঐ মহল্লার, ও শালা লীগের। একে মারো এ শালা এই মহল্লার, এ শালা দলের।
সুন্দর জীবনের খোঁজেসুন্দর জীবনের খোঁজে ওর হাতে ছিল বাতাসার প্যাকেট, মৌরির ডাল, আর ছিল হাওয়াই মিঠাই। জান হাতে নিয়ে কোনোরকমে ওর বাবা যখন ওকে কোলে নিয়ে বান্নির বাইরে আসে তখন হাতে আর কিছু নেই। আছে কেবল আতঙ্ক, আর্তনাদ, আর বুকফাটা কান্না।
বৈশাখীমেলার আয়োজন কারা করবে? কীভাবে করবে? কার ভূমিকা কী হবে, কতখানি হবে, এই নিয়ে বিবাদ। আর সেই বিবাদে সব আয়োজন, সকল আনন্দ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
পুরনো স্মৃতি সরিয়ে, আজ সে নিজ সন্তানকে মেলা বা বান্নি দেখতে পাঠিয়ে, ওদের জন্য অপেক্ষা করে, প্রার্থনা করে। তবে, ওর মনে জ্বলজ্বল করে পুত্রের কপালে গোল কালো টিপ আছে। নজরকাটা টিপ…।