ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে দরকার সঠিক কাউন্সিলিং
এম.এস রিয়াদ, (বরগুনা) :
ইদানিং বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ ঘটনা। যার শিকার অধিকাংশই স্কুল ও ইন্টার পড়ুয়া ছাত্রীরা। মূলত এ ঘটনা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। সেই সাথে বর্তমান প্রজন্মের চড়া অবক্ষয়।
আইনের মারপ্যাঁচে জটিলতা থাকায় এ ধরনের অবক্ষয় দিন দিন বাড়ছে। তবে প্রয়োজন পরিবার ও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট কাউন্সিলিং। একমাত্র এ কাউন্সেলিংই পারে এমন সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে। এমন মন্তব্যই করছেন সমাজের নেটিজনরা।
নারীকে পণ্য ও ভোগের সামগ্রী মনে করা। নারীর উগ্র পোশাক ও চলাফেরা। পর্নোচিত্রের অবাধ ছড়াছড়ি। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়নের প্রধান কারণ বলেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সমাজবিদরা।
কোনটি প্রেম এবং কোনটি ভালোবাসা সেটি না বুঝেই বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এতে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেয়। দু'একটি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালেও স্বল্প সময়ের মধ্যে সংসার ভাঙতে দেখা গেছে। যা উভয় পরিবারকে সংকটে ফেলে দেয়।
ঘটে যাওয়া বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার টিকটক নিয়ে ভিডিও ভাইরালকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করছে। এমন ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটার পরেও পাথরঘাটা থানা পুলিশ ভুক্তভোগী ও মায়ের করা অভিযোগ গ্রহণ না করে তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে। ফলে আত্মহত্যা করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই ভুক্তভোগী ও তার মা। যদিও পরে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করে আলোচনা-সমালোচনার তোপের মুখে ভুক্তভোগী ওই মেয়ের মায়ের করা মামলা গ্রহণ করে পাথরঘাটা থানা পুলিশ। কিন্তু আজ পর্যন্ত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি পুলিশ।
অথচ যে ঘটনাটি ঘটেছে তা কেবল ওই মেয়েটি দায়ী নয়। দায়ী এ সমাজের প্রতিটি নাগরিক। যারা আজও সৃষ্টি করতে পারেনি একটি সুন্দর ও মনোরম পরিবেশের সমাজ। একটি কন্যা শিশু জন্ম গ্রহণের পর থেকেই অবহেলার পাত্র হিসেবে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে তাদের স্থান থাকে যথেষ্ট নড়বড়ে। এটি মূলত পরিবার থেকে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
বন্ধুসুলভ আচরণ থেকে বঞ্চিত প্রায় নব্বই শতাংশ শহর ও শহরতলীর ছেলে-মেয়ে। সবথেকে ছোট বিষয়টিও পরিবারের পিতা-মাতার সাথে শেয়ার না করতে পারা সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসেবে ধরছে সমাজবিদরা।
ইভটিজিং সময়ের অতিমাত্রায় আলোচিত একটি বিষয়। ইভটিজিং দেশের হাজারো সমস্যাকে ছাপিয়ে এখন প্রধান সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক কালের ভয়ংকর এ সমস্যার হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত ও অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা বহু কিশোরী-তরুণীর আত্মহননের নির্মম পথ বেছে নেয়া এবং ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক কিংবা মমতাময়ী মা ও অভিভাবকের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। সামাজিক মুল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে গিলে খাওয়া ভয়ানক এ ইভটিজিং সমস্যা থেকে পরিত্রাণ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা ইভটিজিং এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন- ইভটিজিং মানে হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি যৌন হয়রানি। যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অশালীন মন্তব্য, শিস বাজানো, উদ্দেশ্যপূর্ণ যৌন আবেদনময়ী গান গাওয়া, পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন, চিঠি, ই-মেইল, টেলিফোন, এসএমএস, কার্টুন পাঠানো, চেয়ার-টেবিল ও দেয়ালে যৌন আবেদনময়ী লেখা, লম্পট চাহনী, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, উস্কানিমূলক হাততালি, অস্বস্তিপূর্ণ অপলক দৃষ্টি, উড়ন্ত চুমু (Flying kiss) ইঙ্গিত, চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ও শরীরে ধাক্কা দেওয়া বা অন্য যে কোন উপায়ে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে উত্ত্যক্ত করাই হচ্ছে ইভটিজিং। ইভটিজিং নারী জীবনে সবচেয়ে বাজে ও ভয়ানক অভিজ্ঞতা। নারী জীবনে বিষাক্ত ইভটিজিংয়ের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইভটিজিং নারীকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইভটিজিং নারীর অবাধ চলার স্বাধীনতায় বাধার সৃষ্টি করে, কেড়ে নেয় তার অফুরান প্রাণচাঞ্চল্য। ইভটিজিংয়ের উৎপাত শুধু ভুক্তভোগী মেয়েটির উপরই নয়; বরং তা আছড়ে পড়ে তার পুরো পরিবারের উপর। ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নারী হারিয়ে যায় হতাশার অথৈ সাগরে, যার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে নির্মম আত্মহননের মধ্য দিয়ে। ইভটিজিংয়ের এ প্রভাব শুধু নারীর প্রাণের নির্মম বলিদানেই শেষ হয় না বরং তার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো সমাজ। বাধাপ্রাপ্ত হয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ ইভটিজিংয়ের ৮০ ভাগ ঘটনা ঘটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশেপাশে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরাই বেশী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। ফলে ইভটিজিং থেকে বাঁচতে শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে পড়ে অসংখ্য মেয়ে।
ফলে বেড়ে যাচ্ছে বাল্যবিবাহের প্রবণতা, যা আমাদের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। ইভটিজিং এ শিকার হচ্ছে কর্মজীবী নারীরাও। চলার পথে কিংবা কর্মস্থলে ইভটিজিংয়ের শিকার হন তারা। ক্ষেত্রবিশেষে ইভটিজিংয়ের শিকার নারীরা বাধ্য হয় চাকরি ছেড়ে দিতে, যা তাদের আত্মনির্ভরশীলতার পথকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে নারীর আত্মকর্মসংস্থান তথা আত্মনির্ভরশীলতা অপরিহার্য। এমনিভাবে ইভটিজিং দেশের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে।
এদিকে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ, সেমিনার, মানববন্ধন, প্রবন্ধ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ করলেও ইভটিজিং কিন্তু কমছে না বরং সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ইভটিজিং ক্যান্সার রোগের মতো প্রকট আকার ধারণ করছে। কি গ্রাম আর শহর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে সমান তালে।
দেশব্যাপী অধিকতর এ ইভটিজিংয়ের পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। সন্তান বেড়ে ওঠা তথা সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মাতা-পিতার অসচেতনতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় সুস্থ চরিত্র গঠন উপযোগী, যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার কারিকুলাম না থাকা, মেয়েদের উগ্র পোশাক পরে দেহ প্রদর্শনী ও চলাফেরা, ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাচ-গানের যথেচ্ছ ব্যবহার, নারীকে পণ্য ও ভোগ্যবস্তু মনে করা, স্যাটেলাইট টিভির অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শনের মাধ্যমে পর্নোর ছড়াছড়ি এবং সর্বোপরি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব।
বিশ্লেষকরা প্রতিকারের বিষয়ে বলছেন- ইভটিজিং প্রতিরোধে সন্তানের বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণে পরিবারের যথাযথ ভূমিকা পালন করা, মেয়েদের শালীন পোশাক পরিধানের মানসিকতা তৈরি করা এবং শালীনভাবে চলাফেরা করা, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির উপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা, সামাজিক মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুনীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, সুস্থ বিনোদন ও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি করা, সর্বত্র অশ্লীলতা, যৌন বিকার, কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করা, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আলস্য, আড্ডাবাজি ও খারাপ কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা, ইভটিজিং তথা যৌন হয়রানি রোধে পৃথক আইন পাসসহ তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং জনসমক্ষে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আজকে আধুনিকতার নামে ধর্মীয় জ্ঞানকে পরিত্যাগ করার ফলে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে চারিত্রিক মাধুর্য, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানবিকতা।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন- প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের নিয়ে প্রতিমাসে একটি করে মাসিক মিটিং এর আয়োজন করা। যে মিটিং থেকে জানতে পারবে তার সন্তান শিক্ষায় কতটা অগ্রগতি করছে। সে ঠিকভাবে ক্লাস করছে কিনা কিংবা পড়াশোনার গতানুগতিক অবস্থা সম্পর্কে জানা টা খুবই সহজ হবে।
তিনি আরো বলেন এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের টহলদারি জোরদার করলে পথে-ঘাটে ইভটিজিংয়ের প্রভাবটা দিনে দিনে কমে আসবে।
এছাড়াও এমন কোমলমতি শিশু কিংবা বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পরিবার থেকে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তার সন্তানের বিদ্যালয় কিংবা প্রাইভেট পড়ার সময় ব্যতিরেখে দেরিতে বাসায় ফিরলে কারণ জানতে চাওয়া। সেই সাথে যুক্তিসঙ্গত কারণ না হলে তা খতিয়ে দেখা। তাছাড়া প্রতিটি পরিবার তার সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ এর মাধ্যমে এমন সামাজিক ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে পারে সমাজ।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহেরুন নাহার মনি জানান- প্রথমত পরিবারকে তার সন্তানের খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারের পরেই দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর বর্তায়। এতে পরিবারকে তার সন্তানের সাথে সুন্দর একটি বন্ধুত্ব তৈরি করাটা মুখ্য বিষয় বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। পরিবার থেকে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণেই মূলত ইভটিজিং কিংবা যৌন হয়রানির মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে থাকে।
তিনি আরো বলেন- একটি মেয়েকে তার বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো দিক গুলো দেখে নিতে হবে। পড়াশোনার বাইরে যে বন্ধুটি কেবলমাত্র পারিবারিক খোঁজখবর নিবে এমন বন্ধুকেই নির্বাচন করা শ্রেয়।
এ বিষয়ে বরগুনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে, এম, তারিকুল ইসলাম বলেন- পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের পুলিশি টহল আরো জোরদার করব। তবে ইভটিজিং ও যৌন হয়রানির মতো অপশক্তিকে নির্মূল করতে হলে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।