পশ্চিম রেলের ৯৯ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন হয়নি শত বছরেও
অমাজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী ব্যুরো) :
মাত্র ৯৯ কিলোমিটার রেলপথ ১০০ বছরেও স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতাধীন রহনপুর ও সান্তাহারবাসীর রেলপথের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে গেলে। এই রেলপথ প্রকল্পটি দীর্ঘ ৮ যুগের বেশি সময় ধরে ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ রেলওয়ে জংশন সান্তাহার থেকে নওগাঁ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত এই রেলপথের দাবি-দাবিই থেকে গেল।
শুধু তাই নয়, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে কেটেছে যুগের পর যুগ। কিন্তু নওগাঁবাসীর এই দাবি পূরণে কোনো সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এই প্রকল্পটির আদৌ আলোর মুখ দেখা নিয়ে সন্দিহান সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন- ‘রহনপুর ও সান্তাহার রেলপথ প্রকল্পটি যুগের পর যুগ ধরে একই অবস্থায় ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। ওই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের প্রকল্পটি বাস্তাবায়নে আরো গতিশীল ভূমিকা রাখতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে পাকশি বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম জানান, ‘এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। শুরু থেকে একই অবস্থায় পড়ে আছে।’
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা গেছে, ১৯২০ সালে তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট সরেজমিন রেলওয়ে প্রকল্পটি সার্ভে সম্পন্ন করে। ব্রিটিশ বিতাড়িত হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে ৩ বার জরিপের প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হলেও ফাইলটি বারবার চাপা পড়ে যায়।
১৯৪৭ সালের পর থেকে জনগণের ক্রমাগত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রেলওয়ে বোর্ড ১৯৬৩ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষে পুনরায় জরিপ কাজ চালায়। এই জরিপ দলের নেতা উর্দ্ধতন রেলওয়ে কর্মকর্তা মরহুম আশরাফ আলী ডেল গ্রিনের রিপোর্টের স্বপক্ষে প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করেন। আশরাফ তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৪ পৃষ্ঠা লিখিত রিপোর্টে এ প্রকল্পের একটি ব্লুপ্রিন্ট ১৯৬৪ সালে তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে দাখিল করেন।
কিন্তু সব ব্যাপার সম্পন্ন হওয়ার পর রেলওয়ে বোর্ড হঠাৎ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর শুরু হল ১৯৬৬ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬৯ র পূর্ব বাংলার গণঅভ্যূথান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ মুক্তি সংগ্রামের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ, স্বল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এক চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আশা সঞ্চারিত হলেও তাঁ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে শান্তাহার-রহনপুর রেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে।
আশরাফ আলী জরিপ কমিটির প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী সান্তাহার রেলওয়ে জংশন থেকে নওগাঁ শহর, মহাদেবপুর উপজেলার মহিষবাথান বাজার, পতœীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভা, পোরশা উপজেলার সারাইগাছী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার রেলপথ হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীকালে প্রকল্পটি হাতে নিয়েও বন্ধ করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
জানা গেছে, তৎকালীন জরিপে মাইল হিসেবে ৬৩ মাইল দীর্ঘ নওগাঁর শান্তাহার থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলওয়ে প্রকল্পটি ব্রডগেঞ্জ নির্মিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, ওই প্রকল্পটিতে ১১টি রেলওয়ে স্টেশন রাখা হয়েছিল।
স্টেশনগুলোর নাম- নওগাঁ টাউন, হাটনওগাঁ, হাঁপুনিয়া, জাহাঙ্গীরাবাদ, মহিষবাতান, মামুদপুর, মধইল, হযরতপুর, নিতপুর, পোরশা, নিয়ামতপুর, দাউদপুর। এছাড়া নওগাঁ সরকারি কলেজের উত্তরে ছোট যমুনা নদীর উপরে একটি ব্রিজ এবং নজিপুরের আত্রাই নদীর উপর অপর একটি ব্রিজ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৯ সালে পার্লামেন্ট বাজেট আলোচনায় শান্তাহার-রহনপুর রেলওয়ে প্রকল্পটি আলোচনায় স্থান পায়। রেলওয়ে পশ্চিম জোন কর্তৃপক্ষের প্রকল্পটির বাস্তবায়নের জন্য কোনো সাড়া মিলে নি।
নওগাঁর বদলগাছী, মহাদেবপুর, পতœীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মান্দা ও চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জবাসীর প্রাণের দাবি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চাঁপাইয়ের সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে নওগাঁর সান্তাহারসহ দেশ বিদেশের পণ্য স্বল্পব্যয়ে খুব সহজে আমদানি-রপ্তানি করা যাবে।
সম্প্রতি ৪৭ নওগাঁ-২ আসনের এমপি শহীদুজ্জামান সরকার ওই প্রকল্পের দাবিটি পার্লামেন্টে উত্থাপিত করেন কিন্তু সাড়া মিলে নি। এনিয়ে মুঠোফোনে তিনি জানান, ‘শান্তাহার থেকে রহনপুর রেলওয়ে প্রকল্পের ব্যাপারে আমরা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছি।’ নওগাঁর শান্তাহার ব্রডগেজ রেলওয়ের স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম ডালিম জানান, ‘জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে একটা পরীক্ষামূলক সমীক্ষা চালিয়ে ছিল। এটা অনেক আগের পুরানো প্রজেক্ট।’
রহনপুর স্টেশন মাস্টার মো. মামুনুর রশিদ জানান, শান্তাহার-রহনপুর রেলওয়ে প্রকল্পের ব্যাপারে কয়েক বছর আগে প্রশাসনের একটা টিম এসেছিল। তার জানা মতে ওই অবস্থায় রয়েছে।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামান খান জানান, ‘এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে যোগাযোগ ও অন্যদিকে পণ্যে পরিবহণে সুবিধা হবে। শুধু তাই নয়, ভারতের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যও আরো প্রসারিত হবে।’
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক তৌরিদ আল মাসুদ রনি জানান, রহনপুর ভারত সিমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের একটি স্টেশন। আর শান্তাহার নওগাঁ জেলার অন্তগত। শান্তাহার থেকে রহনপুর সরাসারি রেল যোগাযোগ নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতি হবে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া-আসা অনেক সুবিধা হবে আমাদের।
রাজশাহী পশ্চিম রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ জানান, ‘এই প্রকল্পের বিষয়ে আমার জানা নেই।’