জাককানইবির সাবেক ভিসিকে নিয়ে শিক্ষার্থীর আবেগঘন ষ্টেটাস
আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ, (ত্রিশাল) :
২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে এক অলস দুপুরে “অগ্নিবীণা হল” এ ৩০২ নাম্বার রুমে দুপুরের খাবার সেরে একটু আয়েশ করছি। এমন সময় মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো, ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখি VC Sir লেখা ভেসে উঠছে। নিমিষেই সকল উদাসীনতা কাটিয়ে ফোন রিসিভ করলাম। টু দ্য পয়েন্টে কি কি কথা হয়ে এত বছর পরে আর মনে না থাকলেও মূল কথাটুকু আজীবন মনে থাকবে। স্যারের ফোনে বললেন, “ জীবন, বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর হয়েছে, সেটা কি জানো? তোমরা ক্যাম্পাসে যারা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী আছো তারা আজ বিকালেই “বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর” হওয়া উপলক্ষ্যে একটি কর্মসূচি পালন করো। আর আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যাগে কর্মসূচি পালন করা হবে। আমি ঠিক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছিলাম না। আমি শুধু স্যারকে বললাম এত দ্রুততম সময়ে কি স্যার কর্মসূচি সাকসেসফুল করতে পারবো? স্যার শুধু বললেন “ আদর্শের প্রতি ভালোবাসা থাকলে অবশ্যই একটি সফল কর্মসূচি করতে পারবে।” এত টুকুই। নিজের ভিতরে প্রচন্ড চাপ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে একে একে আমাদের বলয়ের শীর্ষ ছাত্রনেতা জাকিবুল হাসান রনিকে ফোন দিলাম; ছাত্রলীগের ভিন্ন বলয়ের তৎকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা বেনজির আহমেদ আর কামরুজ্জামান অপুকে ফোন দিলাম। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু করার চেষ্টা করলো। বিকাল ৫টা নাগাদ আমাদের বিজয় মিছিল শুরু হয়। বিজয় মিছিল শেষে শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও মিষ্টি বিতরণ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সফল কর্মসূচি পালন। রাত ৮টার কিছু পরে আবার VC Sir ফোন দিলেন। ইতিমধ্যে উনি কর্মসূচির সকল কিছুর খবরাখবর জেনে নিয়েছেন। স্যার, ধন্যবাদ জানালেন। প্রচন্ড খুশি হলাম। এতক্ষণ বলছিলাম আমার VC Sir, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যারের কথা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক সময়কালে যিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। তাই স্যারকে নিয়ে অনেক অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে।
গতকাল ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার নিউমোনিয়া ও বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। স্যারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় স্যারের সাথে আমার ও আমাদের কিছু শেয়ার করার জন্যই লিখতে বসেছি।
আমার দৃষ্টিতে অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো, উনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে আমার মনোজগতটাই আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন। সেটা কেমন একটু খোলাসা করে বলি। গিয়াস স্যার ছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে প্রথম ভিসি, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা তখন কেউ দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। আমরা এতদিন দেখে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক “মোঘল সম্রাট”দের মত আচরণ করে। কতিপয় প্রভাষকও উনাদের পদাংক অনুসরণ করে। উনারা যখন ছাত্রদের সাথে কথা বলতেন মনে হতো রাজা-বাদশাহ তার দাস-দাসীর সাথে কথা বলছে নচেৎ ছাত্র-ছাত্রীদের গা থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাই উনারা বিরক্ত হচ্ছেন। এই রকম এক মানসিক সেট-আপের মাঝে যখন অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার উপাচার্য হিসেবে আসলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকবৃন্দদের নিয়ে পূর্বের ভাবনার আমূল পরিবর্তন হলো। স্যার ছিলেন একদম সাদামাটা এক মাটির মানুষ। এটি শুধু কোন কথা কথা না, এটিই সত্য। স্যার যখন সকালে অফিসে আসতেন আর আমরা ক্লাসে আসতাম, প্রায় সময় স্যারের সাথে দেখা হতো। স্যার, হসিমুখে জিজ্ঞেস করতেন “ জীবন, কেমন আছো?” শুধু আমি নই, আমি দেখেছি, স্যার অনেককেই চলতি পথে নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন; মিউজিকের আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু, মাহমুদুল আহসান লিমন, মামুন রনি, আশিক; ইংরেজির আবু বকর সিদ্দিক; বাংলার আরমান, সিরাজ; সিএসইর আনোয়ার হোসেন প্রমুখদের জিজ্ঞাসা করতে দেখেছি- কেমন আছো, পড়ালেখা কেমন হচ্ছে, ইত্যাদি। তখন সেইসব দাপুটে শিক্ষকদের চোখে মুখে যে বিরক্তির অভিব্যক্তি ফুটে উঠতো সেটাও আমার দৃষ্টি এড়ায় নি।
এলাকাবসীর সাথেও স্যারের একটি সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। কোন এক অনুষ্ঠানে এক প্রভাবশালী অধ্যাপক ভিসি স্যারে সাথে এলাকাবাসীর এই সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। অধ্যাপক ড. গিয়াস স্যার খুব ঠান্ডা ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন “ বিশ্ববিদ্যালয় কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ( Isolated Island) নয়, যে এলাকাবাসীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। স্যার, আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছিলেন, কারা কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেক হোল্ডার।” স্যারের এই বক্তব্য শোনার পরে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার নিজস্ব ভাবনার জগতেও এক আমূল পরিবর্তন আসে।
অধ্যাপক ড. গিয়াস স্যার ভিসি হিসেবে যোগদানের কিছুদিন পরেই আমার বিভাগে ( কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) এক সংকট দেখা দেয়। আমরা বিভাগের শিক্ষকবৃন্দের মাধ্যমে জানতে পারি আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী দেয়া হবে না, আমরা অনার্স ডিগ্রী পাবো। সেই অনুযায়ী প্রশাসনিক ভবন থেকে আমাদের যে আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়েছে সেখানেও অনার্স ডিগ্রীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তখন বিভাগে মাত্র তিনটি ব্যাচ। আমরা তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিবাদ করি। আমরা সকল ক্লাস বর্জন করে সমস্যাটির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বিভাগের সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখার আন্দোলন শুরু করি। আমরা ভিসি স্যারের দ্বারস্ত হই। স্যার উনার দপ্তরে আমাদের শিক্ষার্থীদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। আমরা আমাদের দাবী দৃঢ় ভাবে পেশ করি এবং আমাদের আইডি কার্ড স্যারের কাছে ফেরত দিতে চাই। আমাদের এই কথা শুনে তৎকালীন ট্রেজারার স্যার ( আমাদের ফ্যাকাল্টির ডীন) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অথচ অধ্যাপক ড. গিয়াস স্যার অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাবে বলেন “ ওরা ছোট মানুষ তাই ওরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী চায়। একই ধরনের সিলেবাস পড়িয়ে যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী দেয়, তাহলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেনো? ওদের দাবী যৌক্তিক ও ন্যায্য।” স্যার আমাদের কাছে নেক্সট একাডেমিক কাউন্সিল ও সিণ্ডিকেট মিটিং পর্যন্ত সময় চায় এবং আমাদের ক্লাসে ফিরে যেতে বলে। আমরা ক্লাসে ফিরে আসি। এবং আমরা দেখেছি, স্যার আমাদের কথা রেখেছিলেন। আমার মনে আছে পরের সিন্ডিকেটেই আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীর দাবীটি পাশ করা হয়।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার একাধারে যেমন একজন দক্ষ একাডেমিশিয়ান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন আবার অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে প্রশাসনিক দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। আমি দেখেছি তৎকালীন সময়ের ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের স্যার স্নেহ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্কলারশীপ প্রদান অনুষ্ঠানে স্যার আমাকে দেখে অন্য অতিথিদের বলেছিলেন দেখেন আমাদের “ছাত্রলীগের জীবন” স্কলারশীপ পেয়েছে। স্যার সভামঞ্চেই জিজ্ঞাসা করলেন ছাত্রলীগের আর কেউ স্কলারশীপ পেয়েছে কিনা। তখন আমি স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম সিএসই দ্বিতীয় ব্যাচের শামীম আহমেদ একজন ছাত্রলীগ কর্মী স্কলারশীপ পেয়েছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে প্রথমবারের মত আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য ড. শেখ সুজন আলী স্যার ও ড. রাজু আহমেদ স্যারের নেতৃত্বে আমরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে যাই। এই আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ফাহাদুজ্জামান শিবলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেখানে আমরা প্রথম বিতর্কে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরাজিত করে জয় লাভ করি। বিতর্ক দলের দলনেতা ছিলাম আমি, অন্য দুজন ছিলো সিএসই র নাহিদ, আর অর্থনীতির আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ অপু (দ্বিতীয় বিতর্ক থেকে দলে যুক্ত হয় ফাহাদুজ্জামান শিবলী)। আমাদের জয়ের সংবাদ ক্যাম্পাসের অনেককেই ফোনে জানানো হয়। ভিসি স্যার যেকোন ভাবে সংবাদটি জেনে আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায় এক অবিস্মরনীয় অবদান রেখে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ধরনের সুস্থ ধারা সাংস্কৃতিক চর্চায় স্যার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নানা সংকটে স্যার ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে একান্তে আলোচনা করেছেন। আমি যতটুকু জানি, অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার তৎকালীন সময়ের ছাত্রনেতাদের মধ্যে জাকিবুল হাসান রনি, বেনজির আহমেদ, কামরুজ্জামান অপু প্রমুখদের সাথে অত্যন্ত স্নেহ ভালোবাসা নিয়েই কথা বলতেন। স্যার হয়তো আরো অনেকের সাথেই কথা বলেছেন যা আমার জানা নাই।
পরিশেষে বলবো, আরো অনেক কথা লিখতে পারতাম কিন্তু তাতে হয়তো অনেকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে, তাই শেষ কথা লিখছি। অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার শুধু একজন উপাচার্য হিসেবেই নয় একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। একটি সহজ সরল ও সাদামাটা সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করেও কিভাবে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কাজ করা যায় তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন ছিলেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ স্যার।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে স্যারের সাথে সর্বশেষ দেখা হয়। স্যার দেখেই চিনতে পারলেন। স্যার বলেছিলেন তুমি “ছাত্রলীগের জীবন, কম্পিউটার সায়েন্স”। স্যার সেদিন দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেটাই স্যারের সাথে শেষ দেখা।
স্যারের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। না ফেরার দেশে আপনি ভালো থাকুন, আপনার প্রতি এই সামান্য ছাত্রের একবুক ভালোবাসা….
ফেরদৌস আনাম জীবন
সাবেক শিক্ষার্থী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ও
বিভাগীয় প্রধান
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় জামালপুর।