বিশ বছরেও পায়ের শিকল খোলা হয়নি শংকরী রানী গুহ’র
এস.এম রফিক, (দুর্গাপুর) :
বিশ বছরেও পায়ের শিকল খোলা হয়নি নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার বাসিন্দা মানসিক ভারসাম্যহীন শংকরী গুহ’র। সে পৌর শহরের ৪নং ওয়ার্ড আমলাপাড়া মহল্লার বাসিন্দা স্বর্গীয় শম্ভুলাল গুহে’র তৃতীয় কন্যা। এছাড়াও রয়েছে তার অষ্টমী রানী গুহ ও তৃপ্তি রানী গুহ নামের বড় দুই বোন এবং জীবন গুহ নামের এক ছোট ভাই। প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও এখন তার জীবন কাটছে ময়লা আবর্জনা দুর্ঘন্ধময় পরিত্যাক্ত বাঁশের তৈরি টয়লেটের মধ্যে তিনটি বাঁশের ওপর শিকলবন্ধী অবস্থায়। পরনে কালো রঙের জামা পুরাতন হয়ে ছিড়ে হয়েছে কয়েক টুকরো। তা দিয়েই কোনরকমে ঢাকা শরীর টুকু। মাথার চুল গুলো শক্ত হয়ে বেঁধেছে জটলা। প্রয়োজনের তুলনায় তাকে দেওয়া হচ্ছেনা খাবার,করানো হচ্ছেনা গোসল,এমনকি পরিস্কার করানো হচ্ছেনা তার গায়ের মলমুত্রও বর্তমানে বয়স তার ৪৫ উর্ধ।
মেধাবী এই শিক্ষার্থী শহরের বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করেছেন দীর্ঘদিন। পড়াশোনাকালীন সময়ে বাবার মৃত্যুতে থমকে যায় তাদের পুরো পরিবার। বাবার শোক কাটিয়ে মামা’র বাড়ীতে থেকে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও দারিদ্রতার কারণে নবম শ্রেণীর গ-ি পেরোতে পারেনি সে। পড়াশোনা বন্ধ করে বাড়িতে সংসারের কাজে মনোনিবেশ শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে হঠাৎ করে একদিন নাকের সমস্যা দেখা দিলে কয়েকদিনের ব্যবধানে তা রূপ নেয় টিউমারে। পরিবারের সদস্যরা এর চিকিৎসা করে ভালো করলেও এরপর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে আচরনের। একপর্যায়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে।
এখান থেকেই শুরু তার বন্দিজীবন। পায়ের কখনো বা মোটা রশি কিংবা শিকল বেঁধে শুরু হয় আটকে রাখার চেষ্টা। পাগল মেয়েকে কোনরকম শান্ত রেখে সবসময় দেখে শুননা করছেন তার মা। তবে ২০১৩ শেষের দিকে তার মায়েরও মৃত্যু হলে সংসারের পুরো বোঝা কাঁধে পড়ে ছোট ভাই জীবন লাল গুহ’র। স্থানীয় একটি প্যাথলজিতে সামান্য বেতনে চাকরি করে কোনরকম সংসার চালিয়ে গেলেও বোনের চিকিৎসার অর্থ যেন কোনভাবেই যুগিয়ে উঠতে পারেন না ঐ ভাই।
তাছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে ভাঙা চোরা টিনের এই একটিমাত্র ঘর। ঘরের দুটি রুমে গাদাগাদি করে থাকেন ৫ সদস্যের পরিবার। বিকল্প কোন ব্যবস্থা না পেয়ে বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের সাথে পরিত্যক্ত টয়লেটের উপর টিনের বেড়া দিয়ে তার ভেতর রাখছে মানসিক ভারসাম্যহীন এই বোনকে। এরপর থেকেই এর ভেতরেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন শংকরীর। সর্বদা নিশ্চুপ থেকে কুটীরের ভিতর লুকিয়ে রাখে নিজেকে। কারো সাথে কথা বলে না সে বাহির থেকে কেউ কিছু দিলে তার ভেতরে নিয়ে চুপচাপ বসে খেতে থাকে। করেন না গোসলও তাই অপরিচ্ছন্ন ও ছেরা কাপড় পড়ে পার করছে বছরের পর বছর।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমরা শংকরী কে এভাবেই ভাঙ্গা টয়লেটের ভিতরেই দেখে আসছি। আমরা কখনোই তাঁকে বাহিরে আসতে দেখি নাই গোসল করতে দেখিনি। খাওয়া-দাওয়া পয়:নিষ্কাশন সবকিছু তিনি টয়লেটের ভিতরে করে। কারো সাথে কোন কথা বলে না তাছাড়া দুর্গন্ধের কারণে কেউ তার সামনেও যায়না। এভাবে একটা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে ? তার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তার ভাই ও অনেক গরিব মানুষ। আর্থিক সংকটের কারণে তাই বোনটিরও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেন তাহলেই হয়তো শংকরী আবারও নতুন জীবনে ফিরে আসতে পারবে।
শংকরীর স্কুল জীবনের সহপাঠী শ্যামল রায় জানান, শংকরীর সাথে আমরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে খেলাধুলা এবং পড়াশোনা করেছি। সে অনেক মেধাবী একজন ছাত্রী ছিলো। বেশিরভাগ সময় সে মামার বাড়ি শিবগঞ্জ থেকেই বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। হঠাৎ করেই কি জানি হয়ে গেল তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন তবুও তাকে ভালো করতে পারেনি। বাবা-মা দু-জনই মারা গেছেন। তার একমাত্র ভাই সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে আর চিকিৎসা করাতে পারেননি। তাই সে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমানে সে যেখানে থাকে পাগলের মতোই ভাঙ্গাচুরা জায়গার মধ্যে রোদ্র হলে পড়ছে আবার বৃষ্টি হলে ভিজছে। এখন তার সামনে যাওয়ার মতই কোন পরিবেশ নাই। বর্তমান সরকার তো অনেকেই মানুষকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন। তাকেও একটু ভালো চিকিৎসা দেয়া যেতো তাহলে সেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো বলে আমরা মনে করি।
শংকরী গুহের ভাই জীবন লাল গুহ জানান, হঠাৎ করেই আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। নাকে একটু সমস্যা হয়েছিলো টিউমারের মতো এরপর থেকেই তার এই সমস্যা হইছে। আমরা ডাক্তার দেখাইছি ওষুধ খাওয়াইছি তারপরও কোনো কাজ হইছে না। আজ প্রায় ২০ বছরের উপরে হয়ে গেছে তাঁর এই মানসিক সমস্যা। তার এই অবস্থা দেখে তো আমার অনেক কষ্ট লাগে কিন্তু কি করবো। আমার তো কোন সামর্থ নাই। সামান্য একটা চাকরি করে আমার কোনো রকমে সংসার চলে। নিজের ঘর ভেঙ্গে পড়তাছে এখন তার জন্য একটা ঘর করে দেবো তারও কোন ব্যবস্থা নেই। ৪/৫ জনের পরিবার চলার সমস্যা আর্থিক সংকট। তাই এখন তার কোন চিকিৎসা করতে পারতেছিনা।