সেই শিশু মারিয়ার জন্য সাতক্ষীরায় ‘মারিয়া ফাউন্ডেশনে’র যাত্রা শুরু
এম.এ জামান (সাতক্ষীরা):
আজ থেকে মারিয়া ফাউন্ডেশনের শুভযাত্রা শুরু হল। আমি এই ফান্ডে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ যারা এই ফাউন্ডেশনের সদস্য হবেন তারা তাদের সুবিধামতো টাকা দিবেন। সেই টাকা দিয়ে ফান্ড গঠন করা হবে। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের রেজিষ্টেশনের মাধ্যমে এই ফাউন্ডেশন করা হয়েছে। তবে যে কেউ এর সদস্য হতে পারবেন। ভবিষ্যতে সমস্যা না হয় সেই বিষয় মাথায় রেখে এই কাজ করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের নাম করা হয়েছে ‘মারিয়া ফাউন্ডেশন’। এর সভাপতি থাকবো আমি এসএম মোস্তফা কামাল। আমি যেখানে থাকি শিশু মারিয়া এবং ‘মারিয়া ফাউন্ডেশন’ এর খোঁজ রাখবো। দেশ-বিদেশ থেকে আমার কাছে অনেকে এই বাচ্চাটিকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি দেয়নি। বাচ্চাটি এখন যেখানে আছে, নিরাপদে আছে। তার দাদী এবং নানী যখন ইচ্ছা দেখে যেতে পারছেন। ‘মারিয়া ফাউন্ডেশন’ এর শুভযাত্রা উপলক্ষে সোমবার বিকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক মিট দ্য প্রেসে এসব কথা বলেন সাতক্ষীরার বিদায়ী জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল।
তিনি আরও বলেন, এক রাতে শিশু মারিয়ার বাবা-মা এবং ভাই-বোনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ফুটফুটে মেয়েটি তখন নি:স্ব। তখন পরিবারের সকলে দিশেহারা। নানী পাগলের মতো বসে আছে। বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আমি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। সবাই বলছিল বাচ্চাটির কী হবে? কেউ তো নেই। এর দায়িত্ব কে নেবে? তখন বাচ্চাটির দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম এবং দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলাম হেলাতলা ইউপি সদস্য নাছিমা খাতুনের। এর পর অনেক চিন্তা করেছি। আজ আমি জেলা প্রশাসক আছি। চলে গেলে কি হবে? সেই ভেবে এই ফাউন্ডেশন করার উদ্যোগ নিয়েছি। আইনি কাঠামোর মাধ্যমে নাসিমা খাতুনের দায়িত্বে থাকবে। ১৮ বছর পর্যন্ত মারিয়ার দেখভাল এবং লেখা পড়াসহ সকল দায়িত্ব থাকবে নাসিমা খাতুনে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সব খরচ বহন করা হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সে (মারিয়া) নিজে যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই গুরুত্ব পাবে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে মারিয়াকে হস্তান্তর করে গেলাম যাতে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা না হয়।
মারিয়ার দেখভালের দায়িত্বে থাকা হেলাতলা ইউপি সদস্য নাছিমা খাতুন বলেন, জেলা প্রশাসক স্যার বদলি হয়ে যাওয়ার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে মারিয়াকে আমার কাছে দিয়ে গেছে এজন্য আমি খুবই খুশি।
মারিয়া ফাউন্ডশের গঠন করেছেন এজন্য স্যারকে অনেক ধন্যবাদ। মারিয়া আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছে। আমি ওকে সন্তান হিসেবে মানুষ করেছি। আজ পর্যন্ত ওকে ছাড়া আমি কোথাও থাকিনি। অন্য কোথাও গেলে সে থাকতে পারবে না। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে মারিয়াকে সুন্দরভাবে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করবো।
তিনি আরও বলেন, দূর দূরান্ত থেকে অসহায় শিশুটিকে দেখতে এখনও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় করেন। আমাকে মা এবং আমার স্বামীকে আব্বু ডাকে মারিয়া। আমি দুই ছেলের মা। আমার কোনও মেয়ে নেই। দীর্ঘ নয়মাস ধরে মারিয়াকে আমি লালন-পালন করছি। বর্তমানে মারিয়াকে আমার সন্তান হিসেবে মেনে নিয়েছি। বড় পরিসরে মারিয়ার জন্মদিন পালন করেছি।
এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. তানজিল্লুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এম.এম মাহমুদুর রহমান, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ বাপী, সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রশিদ সুজনসহ জেলায় কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে মারিয়াকে নতুন জামা এবং মৌসুমি ফল উপহার দেন এবং কোলে তুলে নিয়ে খেলায় মাতেন জেলা প্রশাসক।
প্রসঙ্গত, গত বছর ১৫ অক্টোবর ভোররাতে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলিসা গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে মৎস্য হ্যাচারি মালিক শাহিনুর ইসলাম, তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন, ছেলে সিয়াম হোসেন মাহী ও মেয়ে তাসনিম সুলতানাকে পারিবারিক দ্বন্দের প্রতিশোধ নিতে জবাই করে হত্যা করে শাহিনুরের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম। এসময় নারকীয় এই হত্যাকা-ের মধ্যেও বেঁচে যায় চার মাসের শিশু কন্যা মারিয়া সুলতানা। নারকীয় এ ঘটনার পর দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় আলোড়ন। পাশাপাশি ফুটফুটে শিশুটিকে নিয়ে দেশবাসীর মনে জেগেছিল নানা প্রশ্ন। মারিয়া কেমন আছে, কীভাবে আছে, কীভাবে খাওয়া-দাওয়া করছে, তার ভবিষ্যত কী, এসব বিষয়ে জানার কৌতুহল ছিল কোটি মানুষের। সেসময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক জিএস গোলাম রব্বানীসহ অনেক পরিবার শিশু মারিয়াকে দত্তক হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। তবে মারিয়ার নিরাপত্তার কথা ভেবে যাবতীয় দায়িত্ব নেন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। সেই থেকে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে শিশু মারিয়াকে স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য নাছিমা খাতুনের জিম্মায় রাখা হয়েছিল। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে মারিয়া ফাউন্ডশের তাকে নাছিমা খাতুনের কাছে তুলে দেওয়া হল।