ফ্রিল্যান্সিং এবং সফলতা
সুনান বিন মাহাবুব (পটুয়াখালী):
বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং-এর ইতিহাস খুব বেশি পুরানো নয়। গত তিন-চার বছরে এই পেশা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে ফ্রিল্যান্সিং এর ধারণাটি আগে থেকেই ছিল। এর সুচনা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সর্বপ্রথম ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস ১৯৯৮ সালে SOFT moonlighter.com হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে Elance.com, Rent Acoder.com, Odesk.com, Get A Freelancer.com, Freelancer.com, Limeex change.com সহ আরো অনেক মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠিত হয়। ইন্টারনেটের বিস্তৃতির কারনে বর্তমানে বাংলাদেশেও ফ্রিল্যান্সিং দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। করোনা মহামারিতে তরুন প্রজন্ম অধিকাংশই ঝুকেছে ফ্রিল্যান্সিং এ। এছাড়াও এখন বাংলাদেশে চাকুরির বাজার বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এক সময় বাংলাদেশে প্রায় ৪৭% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার ছিল। করোনা মহামারিতে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় এবং চাকুরির নিয়োগ স্থগিত থাকায় বেকারত্বের হার বেড়ে দাড়িয়ে প্রায় ৭৭% এ। তাই পর্যাপ্ত চাকুরির ক্ষেত্র তৈরি না হওয়ায় বিকল্প পেশা হিসেবে সম্মানজনক অবস্থানে আছে ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্তপেশা। বহিঃবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ফ্রিল্যান্সিং। এ দেশের অনেক ছেলে মেয়ে ঘরে বসে আয় করছে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা। জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্ধলক্ষাধিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশলী অনলাইনে বিশ্বের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দেশের প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিংএ জড়িত। ২০১৬ সালে প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছেন বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা। ২০১৮ সালে প্রায় ৭৪৪ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের কাজ আউটসোর্স হয়েছে। ফ্রিল্যান্সিং (Freelancing) হচ্ছে যখন কোন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাজ করে থাকেন। একজন ফ্রিল্যান্সারের যেরকম রয়েছে কাজের ধরণ নির্ধারণের স্বাধীনতা, তেমনি রয়েছে যখন ইচ্ছা তখন কাজ করার স্বাধীনতা। গতানুগতিক অফিস সময়ের মধ্যে ফ্রিল্যান্সার স্বীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন কোম্পানি সাধারণত আউটসোর্সিং করে উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য। পর্যাপ্ত সময়, শ্রম অথবা প্রযুক্তির অভাবেও আউটসোর্সিং করা হয়। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর কাজগুলো যেমন- Web Development, Software Development, Writing & Content, Design, Multimedia & Architecture, SEO/SEM/SMM, Data Entry ইত্যাদি বিষয়ের উপরে আউটসোর্সিং করা হয়। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং মানে হল, যে কাজ ক্লায়েন্ট অনলাইনের মাধ্যমে আপনাকে দিবে, আপনি সে কাজে চুক্তিবদ্ধ হবেন। নিজে কাজটা করবেন এবং সেটা অনলাইনের মাধ্যমেই ক্লায়েন্টকে ডেলিভার করবেন। পরে ক্লায়েন্ট অনলাইনের মাধ্যমে আপনাকে পেমেন্ট করবে। ভারত, ইউক্রেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, পানামা, নেপাল, বাংলাদেশ, রোমানিয়া, মালয়েশিয়া, মিশরসহ আরো অনেক দেশ এই ধরনের সার্ভিস প্রদান করে থাকে। ইন্টারনেটে অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু আউটসোর্সিংয়ের ওয়েবসাইট হল www.upwork.com, www.freelancer.com, www.99designs.com, www.themeforest.net, www. outsourcexp.com, www. mochimedia.com, www.joomlancers.com| এদিকে ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশ বেশ ভাল অবস্থানে পৌছে গেছে। বাংলাদেশের দক্ষ পেশাদারদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে শত কোটি টাকার। ফ্রিল্যান্সিং এর বিস্তারিত জানার সাথে সাথে আমাদের জানতে হবে কোন ধরনের কাজ রয়েছে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। জানা গেছে, ওয়েব দুনিয়ায় বর্তমানে মোট ওয়েবসাইটের সংখ্যা প্রায় ৬৫ কোটি। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার ওয়েবসাইট। এই বিপুল সংখ্যক ওয়েবসাইট তৈরির জন্য ডিজাইনের পাশাপাশি প্রয়োজন ওয়েব ডেভেলপমেন্টের। নতুন ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট কিংবা পুরনো ওয়েবসাইটকে নতুনভাবে ডেভেলপ করার জন্য প্রয়োজন হয় ওয়েব ডেভেলপার। তাই অনলাইন মার্কেটপ্লেসসহ লোকাল মার্কেটে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের চাহিদা রয়েছে। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ক্যাটাগরিতে ১০ হাজারের অধিক জব রয়েছে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ ডলারের বেশি রেটে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন ফ্রিল্যান্সাররা। এরপর আসা যাক গ্রাফিক্স ডিজাইনের কথায়। গ্রাফিক্স ডিজাইন পেশাটি সবচেয়ে নিরাপদ ও ঝামেলাহীন। নিরাপদ ও ঝামেলাহীন বলার কারণ হলো অন্যান্য পেশার বিপরীতে গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কোনো কাজের অভাব হয় না। এটি একটি সম্মানজনক পেশা। একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার বেশ কিছু কালার, টাইপফেস, ইমেজ এবং অ্যানিমেশন ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। এর আউটপুট ডিজিটাল বা প্রিন্ট উভয়ই হতে পারে। নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করতে পারলে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজের অভাব হয় না। ইন্টার্যাক্টিভ মিডিয়া, প্রমোশনাল ডিসপ্লে, জার্নাল, করপোরেট রিপোর্ট, মার্কেটিং ব্রোশিউর, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, লোগো ডিজাইন, ওয়েবসাইট ডিজাইনসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজের চাহিদা রয়েছে। লোকাল মার্কেট বা অনলাইন মার্কেটপ্লেস যাই বলি না কেনো প্রতিনিয়ত গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজের পরিমাণ বাড়ছে। এ খাত থেকে প্রতিমাসে ২ থেকে ১০ হাজার ডলার আয় করছেন এমন সফল মার্কেটারের সংখ্যাও এখন অনেক। অপরদিকে দিন দিন বিশ্বব্যাপী যত ওয়েবসাইট বাড়ছে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কাজের ক্ষেত্রও বাড়ছে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলোতে দিন দিন বাড়ছে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কাজ। আর এ হিসেবে ফ্রিল্যান্সার হতে চাওয়া তরুণ-তরুণীদের অন্যতম পছন্দ হয়ে উঠেছে এ ক্ষেত্রটি। একজন দক্ষ সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজার মাসে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। আনন্দের সংবাদ হল, জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সম্পর্কিত ব্লগ এসইওমজের ডাটা অনুযায়ী প্রতি ১০০ জন ফ্রিল্যান্স সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজারদের মধ্যে ২৩ জনই নারী। বাংলাদেশেও এটির চাহিদা রয়েছে প্রচুর। অনলাইনে আয় করার সহজ ও সম্ভাবনাময় অপর একটি উপায় হলো লেখালেখি। এটিকে আর্টিকেল রাইটিং বা কনটেন্ট রাইটিং বা কনটেন্ট ডেভেলপিংও বলা হয়। যারা ইংরেজিতে ভালো তারাই লেখালেখিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারে। কনটেন্ট রাইটাররা বিভিন্ন কাজের জন্য কনটেন্ট লিখে থাকেন। তথ্য সংগ্রকালে বাংলাদেশের সফল ২জন ফ্রিল্যান্সারের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা বিগত ৩ বছর যাবত ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করছেন। একজন মোঃ ইসতিয়াক রাফি। তিনি বরিশাল বিভাগীয় সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতার উচ্চ জায়গা দখল করে আছেন। আলাপকালে জানা যায়, শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার পর। চাকুরির পিছনে না ছুটে ঘরেই একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে শুরু করেছিলেন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কাজ। বর্তমানে তার মাসিক আয় ৫০-৬০ হাজারের উপরে। তিনি জানিয়েছেন অনেক সময় হাতে কাজ না থাকতে পারে, তখন হতাশ হলে চলবে না। প্রতিটি কাজে ওঠানামা থাকে। ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে ফ্রিলান্সারদের সামনে এগুতে হবে। অপর আরেক সফল ফ্রিলান্সার দক্ষিনাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার ফুলেন্দু রয়। তিনি মেডিকেল সাইন্সে ডিপ্লোমা করার পরও আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ফ্রিল্যান্সিংএ। ২ বছর গ্রাফিক্স ডিজাইনে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে তার মাসিক আয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। তিনিও চাকুরির পিছনে ছুটেননি। বাংলাদেশে এখনও অনেক এমন রাফি এবং ফুলেন্দু রয়েছে যারা একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ঘরেই আয় করছেন অর্থ। ফ্রিল্যান্সার মানে নিজের ব্যবসা, নিজেই ব্যবস্থাপক, নিজেই হিসাবরক্ষক। শুধু থাকতে হবে সময়সীমার মধ্যে কাজ করার তাড়া এবং ক্রেতার প্রত্যাশা পূরণের ইচ্ছা।