শিরোনাম

South east bank ad

বস্তা সুতাতেই আটকে আছে পাটশিল্প

 প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   বিশেষ সংবাদ

বস্তা সুতাতেই আটকে আছে পাটশিল্প

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

পাট বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। স্বাধীনতার পরের দেড় যুগ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। তবে সময়ের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলেও পাটশিল্পে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ফলে এ খাতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অন্যান্য খাত। যদিও পাটকলের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পাটপণ্যে তেমন বৈচিত্র্য আসেনি। আগের মতোই কাঁচাপাট, সুতা ও বস্তার ব্যবসাই করছে বেশিরভাগ পাটকল। হাতেগোনা কয়েকটি পাটকল বহুমুখী পণ্য ও উপকরণ তৈরি করছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদার তুলনায় তা খুবই সামান্য।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দেশে ৭৭টি পাটকল স্থাপিত হয়। স্বাধীনতার পরে এসব জাতীয়করণ করা হয়। আশির দশকে প্লাস্টিক আসার পর পাটপণ্যের চাহিদা কমে যায়। তখন থেকেই সরকারি পাটকলগুলো সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে একের পর এক বন্ধ করা হতে থাকে সরকারি পাটকলগুলো। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকল এখন অতীত।

২০০০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলে দেশে বেসরকারি খাতে পাটকল স্থাপন বাড়তে থাকে। কিন্তু বেসরকারি খাতও প্রধানত কাঁচপাট, বস্তা ও সুতার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের পাটকলগুলোতে সবচেয়ে বেশি পাটের সুতা উৎপাদন হয়। এরপরই রয়েছে বস্তা। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে তাদের সংগঠনের ২০২টি পাটকল রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের পাটকল মিলিয়ে দেশে তিনশর বেশি পাটকল রয়েছে। কিন্তু সব পাটকল চালু নেই। ১৮০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০টি পাটকল নিয়মিত উৎপাদনে রয়েছে। বাকিরা অনিয়মিতভাবে উৎপাদন করে।

ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, পাট খাতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। দেশের পাটকলগুলো প্রধানত পাটের বস্তা ও সুতা তৈরি করে। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি করা যায় এমন পাটের কাপড় তৈরি হয় খুব কম। দেশের কয়েকটি পাটকলে ৬ বা ৭ ধরনের পাটের কাপড় তৈরি হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার পেতে হলে আরও উন্নত পাটের কাপড় দরকার। এ জন্য বিশেষায়িত পাটকল দরকার। পাশাপাশি চলমান পাটকলগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে নীতি সহায়তা দরকার।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আব্দুল বারেক খান বলেন, দেশের পাটকলগুলো বিভিন্ন সমস্যায় আছে। যে কারণে নতুন ধরনের পণ্য তৈরির উদ্যোগ অধিকাংশ পাটকল নিতে পারছে না।

তিনি বলেন, পাট খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কাঁচাপাটের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে যেতে হবে। পাশাপাশি পাটের মজুত সীমা ২০০ মণে নির্ধারণ করতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে পাটকলগুলোকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁচাপাট কেনাকাটায় ২ শতাংশ উৎসে কর প্রত্যাহার করতে হবে।

পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট এবং পাটজাতীয় (কেনাফ ও মেস্তা) ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। এ থেকে বছরে ৮০ থেকে ৮৪ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। এক সময় পাটের চাষের পরিমাণ বেশি ছিল। আশির দশকে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হতো। কিন্তু উচ্চফলনশীল জাত চাষ হওয়ায় মোট আবাদ কমলেও উৎপাদন কমেনি। উৎপাদিত পাটের অর্ধেকের সামান্য বেশি পাটকলগুলোতে ব্যবহার হয়। বাকি পাট কাঁচাপাট হিসেবে রপ্তানি হয়ে থাকে।

রপ্তানি আয় : ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশ থেকে ১১৬ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৮১ লাখ ডলারের। পাটের সুতা রপ্তানি হয়েছে ৭৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। পাটের বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের। এ ছাড়া পাটের অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য থেকে সরকার ১৪২ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) ৭৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের পাটকলে উৎপাদিত সুতার বেশিরভাগ রপ্তানি হয় তুরস্কে। ভারতে কাঁচাপাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়। নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, সুদান ও আফ্রিকার নানা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়।

একযুগ আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পাট ও পাটপণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল। পাটের সুতা থেকে ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় পায়। এ ছাড়া কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আর পাটের বস্তা রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। অন্যান্য পাটপণ্য রপ্তানি থেকে ওই সময় ৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার রপ্তানি আয় হয়। বর্তমানে প্রতি টন কাঁচাপাটের রপ্তানি মূল্য ৯০০ থেকে এক হাজার মার্কিন ডলার। প্রতি টন পাটের সুতা বা ইয়ার্নের রপ্তানি মূল্য এক হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ ডলার এবং প্রতি টন বস্তা এক হাজার ৫০০ ডলার থেকে ২ হাজার ডলার দরে রপ্তানি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি টন কাঁচাপাট ব্যবহার করে যে পাটপণ্য তৈরি হয় সেগুলো ৩ হাজার ডলার থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত দরে রপ্তানি করা যাচ্ছে। ফলে মূল্য সংযোজিত পণ্য রপ্তানিতে মনোযোগ চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

বহুমুখী পাটপণ্য: এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাটের তৈরি বিশেষ সোনালি ব্যাগ ও পাটপাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় প্রদর্শন করেছে। এ ছাড়া বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালম্যাট, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বাক্স তৈরি করছে। জুট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, দেশে পাট থেকে ২৮৫ ধরনের পণ্য তৈরি হয়, যা দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ সচেতনতা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাটপণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইন্স্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথকেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে পাটের ব্যবহার হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে এগিয়ে এসেছে। ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ আইন করে প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করেছে। এই ২৭টি দেশে ৫০০ বিলিয়ন পিচ শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, আফ্রিকা ও এশিয়ার আরও ৩২টি দেশ প্লাস্টিক ব্যাগ বন্ধ করেছে। এসব দেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এ ছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে তৈরি হয় জুট জিওটেক্সটাইল। যা ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহূত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। আন্তর্জাতিক বাজারেও এ পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দেশের পাটকলগুলোতে বহুমুখী পণ্য তৈরি না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন ধরনের এই বাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না।

সম্ভাবনা রুপালি কাঠির: নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে রুপালি পাটকাঠি। পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পল্গান্ট, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদন হয়। এর অর্ধেকও যদি সঠিকভাবে চারকোল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, পাবনা, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩৩টি প্রতিষ্ঠান পাটকাঠি থেকে চারকোল তৈরি করে রপ্তানি করছে। প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার টন চারকোল রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চারকোল বর্তমানে ৭৫০ থেকে এক হাজার ডলারে বেচাকেনা হচ্ছে। চীন বাংলাদেশের চারকোলের প্রধান ক্রেতা। এ ছাড়া ভারত, মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও তাইওয়ানে এর বড় বাজার রয়েছে।

BBS cable ad

বিশেষ সংবাদ এর আরও খবর: